আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের দু’সপ্তাহ পর ১৯৮০ সালের জানুয়ারীর
দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তান এসেছিলেন ওসামা বিন লাদেন। লক্ষ্য ছিল মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের সহায়তায় আফগান ভূমি থেকে
সোভিয়েত সেনা বিতাড়ন। পাকিস্তানে তিনি থাকলেন প্রায় এক মাস। আফগান
মুজাহিদদের সহায়তা দেয়া নিয়ে আলোচনা করলেন সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের সঙ্গে।
আবার ফিরে গেলেন নিজ জন্মভূমি সৌদি আরবে। অর্থসহ যুদ্ধের নানা সরঞ্জাম
যোগাড় করলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিলেন
যুদ্ধের। ১৯৮২ সালে আবার ফিরে এলেন
পাকিস্তানে। এখান থেকেই ঢুকলেন আফগানিস্তানে। তারপর আফগান মুজাহেদিনকে নিয়ে দীর্ঘ দশ বছর যুদ্ধ শেষে সোভিয়েত সেনাদের তাড়ালেন। ফিরে গেলেন নিজ দেশে। আফগান যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি দক্ষিণ ইয়েমেনিদের পক্ষে জেহাদ ঘোষণা করলেন। একই সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন কুয়েতে ইরাকী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। সৌদি রাজতন্ত্র তখন পর্যন্ত সাদ্দামের পক্ষে। এই সময় তিনি কুয়েত যুদ্ধের সুযোগে সৌদি আরবে মার্কিন সেনা ঘাঁটি স্থাপনের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হন। ফলে সৌদি রাজতন্ত্র আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চলে গেল ওসামার বিপক্ষে। যুক্তরাষ্ট্রের গর্বের প্রতীক টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর ওসামা বিন লাদেন আশ্রয় নিলেন আফগানিস্তানে। সেখান থেকে পাকিস্তানে। যে পাকিস্তানে বসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একাট্টা হয়ে সোভিয়েত সেনা তাড়ানোর বুদ্ধি এঁটেছিলেন, দীর্ঘ একত্রিশ বছর পর সেই পাকিস্তানেই এককালের মিত্র মার্কিন বাহিনীর হাতে প্রাণ দিলেন ওসামা বিন লাদেন। কারও চোখে তিনি বীর, আবার কারও চোখে সন্ত্রাসী।
ওসামা বিন লাদেন ১৯৫৭ সালে ইয়েমেনী বাবা আর সিরীয় মায়ের গর্ভে সৌদি আরবে জন্মগ্রহণ করেন। ৫০ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সপ্তম। তার বাবা মোহাম্মদ আওয়াদ বিন লাদেন গত শতকের ত্রিশের দশকে দক্ষিণ ইয়েমেন থেকে ভাগ্য অন্বেষণে সৌদি আরবে আসেন। জেদ্দা বন্দরে তিনি সাধারণ শ্রমিক হিসেবে যোগ দেন। দ্রুত ভাগ্য বদল হওয়ার একপর্যায়ে তিনি সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় নির্মাণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বিপুল বিত্তবৈভব গড়ে তোলায় আওয়াদ বিন লাদেনের সখ্যতা গড়ে ওঠে সৌদি রাজপরিবারের সঙ্গে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ওসামা তার বাবাকে হারান। ১৭ বছর বয়সে এক সিরীয় মহিলাকে বিয়ে করেন তিনি।
তিনি জেদ্দায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮১ সালে জেদ্দার কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি প্রথমে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পরে লোকপ্রশাসনের ওপর উচ্চতর ডিগ্র নেন। ওসামা ছেলেবেলা থেকেই কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে বড় হন।
পুরো আফগান যুদ্ধ চলাকালে লাদেনকে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে আমেরিকা। এমনও কথিত আছে যে যুদ্ধবাজ আফগান নেতা ও জেনারেলদের মধ্যে যোগাযোগ ও আমেরিকার পক্ষে ভারসাম্য রক্ষায় তখন যে কয়েকজন লোক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, মোল্লা ওমরসহ লাদেন তাদের অন্যতম। আফগান যুদ্ধ শেষ হলে ১৯৮৯ সালের শেষ দিকে তিনি সৌদি আরবে ফিরে যান। পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ( ISI ) এর সাথেও তার ছিল গভীর নির্ভরতার সম্পর্ক। আফগান যুদ্ধ শেষ হলে ১৯৮৯ সালের শেষ দিকে লাদেন সৌদি আরবে ফিরে যান।
১৯৯০ দশকের প্রথম দিকে ইরাক কুয়েত আক্রমণ করলে নিজের দেশকে কিভাবে আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে হবে সে বিষয়ে কিছু সুপারিশ করে তিনি সৌদি সরকারকে চিঠি দেন। এই সময়ই তিনি জানতে পারেন পবিত্র সৌদি ভূমিতে মার্কিন সেনা আসছে। এ ঘটনাই বদলে দেয় ওসামা বিন লাদেনের জীবন। ওসামা বিভিন্ন সময় একথা বলেছেন। এজন্য তিনি বিষণ্নতায় ভুগতে থাকেন এবং অসহায় বোধ করেন। রাজপরিবার থেকে ভালো কোনো সাড়া না পেয়ে তিনি ধর্মীয় বিশারদদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন।
তাদের ফতোয়া অনুসরণ করে তিনি ৪ হাজার সৌদি যুবককে নিয়ে আফগানিস্তানে যান। রাজপরিবার এ ঘটনায় কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। লাদেনের যাতায়াত কেবল জেদ্দায় সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়। তার বক্তৃতা ও কর্মকাণ্ডের জন্য দু’বার জিজ্ঞাসাবাদ এবং সতর্ক করে দেয়া হয়। এসব ঘটনার পর তিনি পাকিস্তান চলে আসেন। কিন্তু এসেই বুঝতে পারেন পাক গোয়েন্দা সংস্থা তাকে সৌদি সরকারের হাতে তুলে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। পাক গোয়েন্দাদের সহায়তায় সৌদি সরকার তাকে অপহরণ ও হত্যার চেষ্টা চালায়। কিন্তু উভয় দেশে তার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু থাকায় তিনি সব পরিকল্পনা আগেই জেনে যান এবং প্রাণে রক্ষা পান। শেষ পর্যন্ত তিনি আফগানিস্তানে চলে যান। কিন্তু এরই মধ্যে আফগান মুজাহিদরা বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এ সংঘর্ষ থামাতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৯১ সালের শেষদিকে তিনি ছদ্মবেশে নিজস্ব বিমানে আফগানিস্তান ত্যাগ করেন।
আফগানিস্তান থেকে ওসামা সরাসরি সুদানে চলে যান। সেখানে কোনো জিহাদ কিংবা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর তার ইচ্ছা ছিল না। মূলত ইসলামী সরকারকে সহযোগিতা করাই তার লক্ষ্য ছিল। তিনি তার কয়েক ভাইসহ অসংখ্য ব্যবসায়ীকে সুদানে বিনিয়োগ করতে উত্সাহ জোগান। তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করলে সুদান দ্রুত উন্নতি লাভ করতে থাকে। কিন্তু এখানেও সৌদি গোয়েন্দারা ওসামাকে গুপ্তহত্যার চেষ্টা চালায়। এই সময় সোমালিয়া এবং দক্ষিণ ইয়েমেনে মার্কিন দূতাবাসে হামলার ঘটনা ঘটে। এই হামলায় জড়িতদের আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বলে চিহ্নিত করা হয়। ফলে ওসামা বিন লাদেনের সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই ঘটনার পর মার্কিন চাপে সৌদি সরকার ওসামার সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। ওসামাও ১৯৯৪ সালে ঘোষণা দিয়ে তার সৌদি নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করে নেন। ১৯৯৫ সালে রিয়াদের মার্কিন ঘাঁটিতে বোমা হামলার দায়দায়িত্ব বিন লাদেন স্বীকার না করলেও সৌদি সরকার হামলাকারীদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে লাদেনকে দায়ী করে। এদিকে এ সময় সুদান সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক মহল লাদেনের ব্যাপারে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। সুদানকে কোনো বিব্রতকর অবস্থায় না ফেলতে ১৯৯৬ সালের প্রথম দিকে ওসামা বিপুলসংখ্যক অনুসারীসহ সরাসরি আফগানিস্তানের জালালাবাদ চলে যান। কিছুদিন পর ১৯৯৬ সালের জুন মাসে সৌদির খোবারে বোমা বিস্ফোরণ হয়। কেনিয়ার নাইরোবি এবং তাঞ্জানিয়ার দারুস সালামে মার্কিন দূতাবাসেও ১৯৯৮ সালে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এসব হামলায় কমপক্ষে ৩শ’ লোক নিহত হন। লাদেন এর দায়িত্ব স্বীকার না করলেও সৌদি সরকার ও যুক্তরাষ্ট্র এর জন্য লাদেনকে দায়ী করে।
১৯৯৩ সালে ওসামা বিন লাদেন জঙ্গি সংগঠন আল কায়দা গঠন করেন। বিভিন্ন দেশের যোদ্ধাদের এর সদস্য করা হয়। এই সংগঠনটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মার্কিন এবং এর মিত্রদের স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা : তৃতীয় বারের মতো আফগানিস্তানে আসার কয়েক মাস পর ওসামা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। ১২ পৃষ্ঠার এক ঘোষণায় তিনি আরব উপদ্বীপ থেকে মার্কিন সেনা তাড়ানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। সৌদি সরকার এ সময় লাদেনের আশ্রয়দাতা তালেবান নেতা ইউনুস খালিসের কাছে তাকে (লাদেন) রিয়াদের কাছে হস্তান্তর করার লোভনীয় প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ইউনুস খালিস তা প্রত্যাখ্যান করেন।
১৯৯৬ সালের শেষ দিকে তালেবান জালালাবাদ দখল করে এবং ওসামা বিন লাদেনকে তাদের সঙ্গে নিয়ে নেয়। এ সময় তালেবান নেতা মোল্লা ওমর তার কাছে দূত পাঠালে তিনি বিস্মিত হন। ওমর তাকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেয়ার অঙ্গীকার ঘোষণা করেন। কিন্তু সৌদি সরকার বসে ছিল না। তারা পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের সহায়তায় আবার ওসামাকে হত্যার পরিকল্পনা নেয়। কিন্তু বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেলে ওসামা কান্দাহার চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। একইসঙ্গে তালেবানকে সহযোগিতা করার জন্য তিনি অনুসারীদের নির্দেশ দেন। ওবামার অনুসারীদের সহযোগিতায় তালেবান আহমদ শাহ মাসুদকে কাবুল থেকে বিতাড়ন করে। তালেবান নেতা মোল্লা ওমর এ সময় লাদেনের সঙ্গে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। ১৯৯৭ সালের প্রথম দিকে দু’জনের মধ্যে দেখা হয়। ওমর এ সময় লাদেনকে প্রকাশ্যে চলাফেরা কম করার অনুরোধ করেন। ওসামা তালেবান নেতার অনুরোধ রক্ষা করেন। এই সময়ই যুক্তরাষ্ট্র ওসামার কান্দাহারের বাসভবনে হামলা এবং কমান্ডো স্টাইলে অপহরণ করার পরিকল্পনা করে। মার্কিন সেনারা পাকিস্তানের মরুভূমিতে এই পরিকল্পনার মহড়াও দেয়। কিন্তু এবারও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মাধ্যমে এই খবর ফাঁস হয়ে যায়। ফলে আমেরিকা এই পরিকল্পনা বাতিল করে। ওসামা আফগানিস্তানেই বাস করতে থাকেন।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে বিমান হামলা চালানো হয়। এই হামলায় টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়ে যায়। এ সময় প্রায় তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারান। হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র আল কায়দাকে দায়ী করে, একইসঙ্গে ওসামাকে ধরার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ওসামা আত্মগোপনে চলে যান। শেষ পর্যন্ত আমেরিকা ও কয়েকটি সহযোগী দেশের সেনাবাহিনী আফগানিস্তানে হামলা চালায়। এই হামলায় তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হয়। এর পর থেকেই ওসামাকে খুঁজে আসছিল মার্কিন সেনারা। ২০০১ সালেই আফগানিস্তানের তোরাবোরা পাহাড়ের গুহায় ওসামা নিহত হয়েছেন বলে প্রচার চালানো হয়। কিন্তু পরে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। ২০০৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে এক ভিডিও টেপের মাধ্যমে ওসামা তার জীবিত থাকার ঘোষণা দেন। একইসঙ্গে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের দায়িত্ব স্বীকার করেন।
এরপর ওসামা কোথায় কীভাবে আছেন, তা ছিল রহস্যাবৃত। তিনি জীবিত কি মৃত—এই প্রশ্নের উত্তর জানা ছিল না কারও কাছে।
ওসামার মৃত্যু নিয়ে ওবামার ঘোষণা : গতকাল বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৯টায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ঘোষণা দিয়েছেন, গত রোববার পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে ৬২ কিলোমিটার দূরে অ্যাবোটাবাদে মার্কিন সেনাবাহিনী ওসামাকে হত্যা করেছে।
পাকিস্তানে। এখান থেকেই ঢুকলেন আফগানিস্তানে। তারপর আফগান মুজাহেদিনকে নিয়ে দীর্ঘ দশ বছর যুদ্ধ শেষে সোভিয়েত সেনাদের তাড়ালেন। ফিরে গেলেন নিজ দেশে। আফগান যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি দক্ষিণ ইয়েমেনিদের পক্ষে জেহাদ ঘোষণা করলেন। একই সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন কুয়েতে ইরাকী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। সৌদি রাজতন্ত্র তখন পর্যন্ত সাদ্দামের পক্ষে। এই সময় তিনি কুয়েত যুদ্ধের সুযোগে সৌদি আরবে মার্কিন সেনা ঘাঁটি স্থাপনের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হন। ফলে সৌদি রাজতন্ত্র আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চলে গেল ওসামার বিপক্ষে। যুক্তরাষ্ট্রের গর্বের প্রতীক টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর ওসামা বিন লাদেন আশ্রয় নিলেন আফগানিস্তানে। সেখান থেকে পাকিস্তানে। যে পাকিস্তানে বসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একাট্টা হয়ে সোভিয়েত সেনা তাড়ানোর বুদ্ধি এঁটেছিলেন, দীর্ঘ একত্রিশ বছর পর সেই পাকিস্তানেই এককালের মিত্র মার্কিন বাহিনীর হাতে প্রাণ দিলেন ওসামা বিন লাদেন। কারও চোখে তিনি বীর, আবার কারও চোখে সন্ত্রাসী।
ওসামা বিন লাদেন ১৯৫৭ সালে ইয়েমেনী বাবা আর সিরীয় মায়ের গর্ভে সৌদি আরবে জন্মগ্রহণ করেন। ৫০ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সপ্তম। তার বাবা মোহাম্মদ আওয়াদ বিন লাদেন গত শতকের ত্রিশের দশকে দক্ষিণ ইয়েমেন থেকে ভাগ্য অন্বেষণে সৌদি আরবে আসেন। জেদ্দা বন্দরে তিনি সাধারণ শ্রমিক হিসেবে যোগ দেন। দ্রুত ভাগ্য বদল হওয়ার একপর্যায়ে তিনি সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় নির্মাণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। বিপুল বিত্তবৈভব গড়ে তোলায় আওয়াদ বিন লাদেনের সখ্যতা গড়ে ওঠে সৌদি রাজপরিবারের সঙ্গে। মাত্র ১৩ বছর বয়সে ওসামা তার বাবাকে হারান। ১৭ বছর বয়সে এক সিরীয় মহিলাকে বিয়ে করেন তিনি।
তিনি জেদ্দায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮১ সালে জেদ্দার কিং আবদুল আজিজ ইউনিভার্সিটি থেকে তিনি প্রথমে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং পরে লোকপ্রশাসনের ওপর উচ্চতর ডিগ্র নেন। ওসামা ছেলেবেলা থেকেই কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনের মধ্যে বড় হন।
পুরো আফগান যুদ্ধ চলাকালে লাদেনকে অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে আমেরিকা। এমনও কথিত আছে যে যুদ্ধবাজ আফগান নেতা ও জেনারেলদের মধ্যে যোগাযোগ ও আমেরিকার পক্ষে ভারসাম্য রক্ষায় তখন যে কয়েকজন লোক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, মোল্লা ওমরসহ লাদেন তাদের অন্যতম। আফগান যুদ্ধ শেষ হলে ১৯৮৯ সালের শেষ দিকে তিনি সৌদি আরবে ফিরে যান। পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই ( ISI ) এর সাথেও তার ছিল গভীর নির্ভরতার সম্পর্ক। আফগান যুদ্ধ শেষ হলে ১৯৮৯ সালের শেষ দিকে লাদেন সৌদি আরবে ফিরে যান।
১৯৯০ দশকের প্রথম দিকে ইরাক কুয়েত আক্রমণ করলে নিজের দেশকে কিভাবে আগ্রাসন থেকে রক্ষা করতে হবে সে বিষয়ে কিছু সুপারিশ করে তিনি সৌদি সরকারকে চিঠি দেন। এই সময়ই তিনি জানতে পারেন পবিত্র সৌদি ভূমিতে মার্কিন সেনা আসছে। এ ঘটনাই বদলে দেয় ওসামা বিন লাদেনের জীবন। ওসামা বিভিন্ন সময় একথা বলেছেন। এজন্য তিনি বিষণ্নতায় ভুগতে থাকেন এবং অসহায় বোধ করেন। রাজপরিবার থেকে ভালো কোনো সাড়া না পেয়ে তিনি ধর্মীয় বিশারদদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন।
তাদের ফতোয়া অনুসরণ করে তিনি ৪ হাজার সৌদি যুবককে নিয়ে আফগানিস্তানে যান। রাজপরিবার এ ঘটনায় কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। লাদেনের যাতায়াত কেবল জেদ্দায় সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়। তার বক্তৃতা ও কর্মকাণ্ডের জন্য দু’বার জিজ্ঞাসাবাদ এবং সতর্ক করে দেয়া হয়। এসব ঘটনার পর তিনি পাকিস্তান চলে আসেন। কিন্তু এসেই বুঝতে পারেন পাক গোয়েন্দা সংস্থা তাকে সৌদি সরকারের হাতে তুলে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। পাক গোয়েন্দাদের সহায়তায় সৌদি সরকার তাকে অপহরণ ও হত্যার চেষ্টা চালায়। কিন্তু উভয় দেশে তার কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু থাকায় তিনি সব পরিকল্পনা আগেই জেনে যান এবং প্রাণে রক্ষা পান। শেষ পর্যন্ত তিনি আফগানিস্তানে চলে যান। কিন্তু এরই মধ্যে আফগান মুজাহিদরা বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এ সংঘর্ষ থামাতে ব্যর্থ হয়ে ১৯৯১ সালের শেষদিকে তিনি ছদ্মবেশে নিজস্ব বিমানে আফগানিস্তান ত্যাগ করেন।
আফগানিস্তান থেকে ওসামা সরাসরি সুদানে চলে যান। সেখানে কোনো জিহাদ কিংবা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানোর তার ইচ্ছা ছিল না। মূলত ইসলামী সরকারকে সহযোগিতা করাই তার লক্ষ্য ছিল। তিনি তার কয়েক ভাইসহ অসংখ্য ব্যবসায়ীকে সুদানে বিনিয়োগ করতে উত্সাহ জোগান। তারা বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করলে সুদান দ্রুত উন্নতি লাভ করতে থাকে। কিন্তু এখানেও সৌদি গোয়েন্দারা ওসামাকে গুপ্তহত্যার চেষ্টা চালায়। এই সময় সোমালিয়া এবং দক্ষিণ ইয়েমেনে মার্কিন দূতাবাসে হামলার ঘটনা ঘটে। এই হামলায় জড়িতদের আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বলে চিহ্নিত করা হয়। ফলে ওসামা বিন লাদেনের সংশ্লিষ্টতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই ঘটনার পর মার্কিন চাপে সৌদি সরকার ওসামার সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে। ওসামাও ১৯৯৪ সালে ঘোষণা দিয়ে তার সৌদি নাগরিকত্ব প্রত্যাহার করে নেন। ১৯৯৫ সালে রিয়াদের মার্কিন ঘাঁটিতে বোমা হামলার দায়দায়িত্ব বিন লাদেন স্বীকার না করলেও সৌদি সরকার হামলাকারীদের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে লাদেনকে দায়ী করে। এদিকে এ সময় সুদান সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক মহল লাদেনের ব্যাপারে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। সুদানকে কোনো বিব্রতকর অবস্থায় না ফেলতে ১৯৯৬ সালের প্রথম দিকে ওসামা বিপুলসংখ্যক অনুসারীসহ সরাসরি আফগানিস্তানের জালালাবাদ চলে যান। কিছুদিন পর ১৯৯৬ সালের জুন মাসে সৌদির খোবারে বোমা বিস্ফোরণ হয়। কেনিয়ার নাইরোবি এবং তাঞ্জানিয়ার দারুস সালামে মার্কিন দূতাবাসেও ১৯৯৮ সালে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। এসব হামলায় কমপক্ষে ৩শ’ লোক নিহত হন। লাদেন এর দায়িত্ব স্বীকার না করলেও সৌদি সরকার ও যুক্তরাষ্ট্র এর জন্য লাদেনকে দায়ী করে।
১৯৯৩ সালে ওসামা বিন লাদেন জঙ্গি সংগঠন আল কায়দা গঠন করেন। বিভিন্ন দেশের যোদ্ধাদের এর সদস্য করা হয়। এই সংগঠনটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মার্কিন এবং এর মিত্রদের স্থাপনায় বোমা হামলা চালায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা : তৃতীয় বারের মতো আফগানিস্তানে আসার কয়েক মাস পর ওসামা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। ১২ পৃষ্ঠার এক ঘোষণায় তিনি আরব উপদ্বীপ থেকে মার্কিন সেনা তাড়ানোর অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। সৌদি সরকার এ সময় লাদেনের আশ্রয়দাতা তালেবান নেতা ইউনুস খালিসের কাছে তাকে (লাদেন) রিয়াদের কাছে হস্তান্তর করার লোভনীয় প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ইউনুস খালিস তা প্রত্যাখ্যান করেন।
১৯৯৬ সালের শেষ দিকে তালেবান জালালাবাদ দখল করে এবং ওসামা বিন লাদেনকে তাদের সঙ্গে নিয়ে নেয়। এ সময় তালেবান নেতা মোল্লা ওমর তার কাছে দূত পাঠালে তিনি বিস্মিত হন। ওমর তাকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেয়ার অঙ্গীকার ঘোষণা করেন। কিন্তু সৌদি সরকার বসে ছিল না। তারা পাকিস্তানী গোয়েন্দাদের সহায়তায় আবার ওসামাকে হত্যার পরিকল্পনা নেয়। কিন্তু বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেলে ওসামা কান্দাহার চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। একইসঙ্গে তালেবানকে সহযোগিতা করার জন্য তিনি অনুসারীদের নির্দেশ দেন। ওবামার অনুসারীদের সহযোগিতায় তালেবান আহমদ শাহ মাসুদকে কাবুল থেকে বিতাড়ন করে। তালেবান নেতা মোল্লা ওমর এ সময় লাদেনের সঙ্গে দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন। ১৯৯৭ সালের প্রথম দিকে দু’জনের মধ্যে দেখা হয়। ওমর এ সময় লাদেনকে প্রকাশ্যে চলাফেরা কম করার অনুরোধ করেন। ওসামা তালেবান নেতার অনুরোধ রক্ষা করেন। এই সময়ই যুক্তরাষ্ট্র ওসামার কান্দাহারের বাসভবনে হামলা এবং কমান্ডো স্টাইলে অপহরণ করার পরিকল্পনা করে। মার্কিন সেনারা পাকিস্তানের মরুভূমিতে এই পরিকল্পনার মহড়াও দেয়। কিন্তু এবারও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মাধ্যমে এই খবর ফাঁস হয়ে যায়। ফলে আমেরিকা এই পরিকল্পনা বাতিল করে। ওসামা আফগানিস্তানেই বাস করতে থাকেন।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে বিমান হামলা চালানো হয়। এই হামলায় টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়ে যায়। এ সময় প্রায় তিন হাজার মানুষ প্রাণ হারান। হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র আল কায়দাকে দায়ী করে, একইসঙ্গে ওসামাকে ধরার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। ওসামা আত্মগোপনে চলে যান। শেষ পর্যন্ত আমেরিকা ও কয়েকটি সহযোগী দেশের সেনাবাহিনী আফগানিস্তানে হামলা চালায়। এই হামলায় তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হয়। এর পর থেকেই ওসামাকে খুঁজে আসছিল মার্কিন সেনারা। ২০০১ সালেই আফগানিস্তানের তোরাবোরা পাহাড়ের গুহায় ওসামা নিহত হয়েছেন বলে প্রচার চালানো হয়। কিন্তু পরে এর সত্যতা পাওয়া যায়নি। ২০০৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে এক ভিডিও টেপের মাধ্যমে ওসামা তার জীবিত থাকার ঘোষণা দেন। একইসঙ্গে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের দায়িত্ব স্বীকার করেন।
এরপর ওসামা কোথায় কীভাবে আছেন, তা ছিল রহস্যাবৃত। তিনি জীবিত কি মৃত—এই প্রশ্নের উত্তর জানা ছিল না কারও কাছে।
ওসামার মৃত্যু নিয়ে ওবামার ঘোষণা : গতকাল বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৯টায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ঘোষণা দিয়েছেন, গত রোববার পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে ৬২ কিলোমিটার দূরে অ্যাবোটাবাদে মার্কিন সেনাবাহিনী ওসামাকে হত্যা করেছে।
No comments:
Post a Comment