February 2, 2018

কেন সাগরের পানি লবনাক্ত?


পৃথিবীর সাগর, মহাসাগরগুলোর পানি লবণাক্ত। গড়ে সমুদ্রের এক লিটার পানিতে ৩০ গ্রামের মত লবণ দ্রবীভূত থাকে। সমুদ্রের পানির ৩.৫% সোডিয়াম ক্লোরাইড বা খাওয়ার লবণ আর পৃথিবীপৃষ্ঠের ৭০%-ই পানি। কাজেই পৃথিবীর মহাসাগরগুলোর মোট লবণের পরিমাণ কিন্তু একেবারে কম নয়, ৫০ মিলিয়ন বিলিয়ন টন। এই লবণ দিয়ে ১৮০ মাইল উঁচু এবং ১ মাইল পুরু দেয়াল তৈরি করা সম্ভব যা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রশস্ত এলাকা অর্থাৎ বিষুবরেখা বরাবর পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে পারে। সমুদ্রের পানিতে এই বিপুল পরিমাণ লবণ কোথা থেকে এলো – এ প্রশ্নের উত্তর মানুষ আজও জানতে পারেনি।
সমুদ্রের পানিতে লবণ কোথা থেকে আসছে?

 
আমরা যা জানি তা হচ্ছে সমুদ্রের লবণের অন্যতম যোগানদাতা ভূপৃষ্ঠ বা ভূপৃষ্ঠে থাকা নানা ধরনের শিলা। বৃষ্টির পানির ফোঁটা মাটিতে পড়ার সময় তাতে বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইড দ্রবীভূত হয় আর এর ফলে সামান্য এসিডীয় ধর্ম তৈরি হয় বৃষ্টির পানির।
মৃদু এসিডীয় ধর্ম পাওয়া বৃষ্টির পানি ভূপৃষ্ঠের শিলার ওপর দিয়ে যাওয়ার সময় শিলা কিছুটা ক্ষয়ে যায়। বিভিন্ন ধরনের আয়ন তৈরি হয়। সহজ ভাষায় পানিতে লবণ দ্রবীভূত হয়। দ্রবীভূত লবণ নদী হয়ে সমুদ্র পৌঁছায়। সূর্যের উত্তাপে সমুদ্র থেকে পানি বাষ্পীভূত হয় কিন্তু নদীর পানির সাথে আসা লবণ থেকে যায়। এভাবেই সমুদ্রর পানি লবণাক্ত হয়ে উঠেছে এমন তত্ত্বের পক্ষে বড় প্রমাণ পৃথিবীর লোনা পানির লেকগুলো।

হ্রদ বা লেকের পানি কেন লবণাক্ত হয়?
পৃথিবীর বড় লেকগুলোতে নদীর পানির প্রবাহ এসে পড়ে। সমুদ্রের মত এক্ষেত্রেও নদীগুলো লবণ বয়ে আনে। পানি বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকলে লেকের পানি লবণাক্ত হয়ে ওঠে না। কিন্তু গ্রেট সল্ট লেক বা ডেড সী এর মত জায়গাগুলোতে পানি বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। একমাত্র বাষ্পীভূত হওয়ার মাধ্যমে এসব লেক থেকে পানি অপসারিত হয়। বাষ্পীভবনের সময় লেকে লবণ থেকে যায় ফলে ধীরে ধীরে লেকের পানি লবণাক্ত হয়ে ওঠে। প্রায় ৩৪০ বর্গমাইলের ডে সী’র পানিতে ১০৫২,৩০,০০,০০০ টন লবণ দ্রবীভূত হয়ে আছে।
একই কারণে প্রায় পুরোটা স্থলভাগবেষ্টিত সাগরগুলো যেমন ভূমধ্যসাগর এবং লোহিত সাগরের পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা তুলনামূলকভাবে বেশি।
অমীমাংসিত প্রশ্ন
সমুদ্রের এই বিপুল পরিমাণ লবণের পুরোই কি নদীগুলো বয়ে এনেছে এ প্রশ্নের উত্তর এখনো নিশ্চিত করা যায়নি। একটি তত্ত্ব হচ্ছে প্রাথমিক পর্যায়ে পৃথিবীর সমুদ্রগুলো সামান্য মাত্রায় লবণাক্ত ছিল। নদীগুলোর বয়ে আনা লবণের ফলেই ধীরে ধীরে লবণাক্ত হয়ে উঠেছে সমুদ্রের পানি।
নদীই যখন সমুদ্রে লবণ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে তখন নদীর পানি লবণাক্ত নয় কেন?
উত্তরটা সহজ। ক্রমাগত বৃষ্টির পানি এসে মেশায় নদীর পানিতে লবণাক্ততার মাত্রা ততটা নয়। নদীর পানির লবণাক্ততার মাত্রা সমুদ্রের পানির ২০০ ভাগের এক ভাগেরও কম।
লবণের খনিতে লবণ কিভাবে এলো?
বাণিজ্যিকভাবে যে পরিমাণ লবণ আহরণ করা হয় তার অধিকাংশই আসে লবণের খনি থেকে। মনে করা হয় দূর অতীতে সমুদ্রের পানি ছিল এমন জায়গাগুলোতেই পানি বাষ্পীভূত হয়ে বিপুল পরিমাণ লবণ সঞ্চিত হয়েছে। এসব জায়গায় যে পরিমাণ পানি প্রবেশ করেছে তার চেয়ে বেশি পরিমাণে পানি বাষ্পীভূত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
সমুদ্রের পানিতে লবণের অন্যান্য উৎস
সমুদ্রের তলদেশে এমন অনেক জায়গা রয়েছে যেখানে শিলাস্তরের মধ্য দিয়ে পানি পৃথিবীর উত্তপ্ত অংশে প্রবেশ করে এবং সেখানকার শিলা থেকে লবণ সমুদ্রের পানিতে দ্রবীভূত হয় এবং সেই উত্তপ্ত পানি আবার সমুদ্রে ফিরে আসে। এটি হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট হিসেবে পরিচিত। এছাড়া সমুদ্রের তলদেশে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলেও দ্রবণীয় খনিজ সমুদ্রের পানির সংস্পর্শে চলে আসে।
সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা কি আরও বাড়বে?
না। মনে করা হয় সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা আর খুব একটা বাড়বে না। অন্তত বিগত কয়েক লাখ বছর ধরে সমুদ্রের পানির লবণাক্ততার মাত্রা প্রায় একই রকম আছে। নদীগুলো যে হারে লবণ সমুদ্রে নিয়ে আসছে অনেকটা সে হারেই সমুদ্রের তলদেশে বিভিন্ন খনিজ জমা হচ্ছে। ফলে মহাসমুদ্রে লবণের মাত্রা তেমন পরিবর্তিত হচ্ছে না।
আরও কয়েকটি তথ্য যোগ করে রাখা যায়, মহাসমুদ্রের সর্বত্র লবণাক্ততার মাত্রা সমান নয়। বরফগলা পানির কারণে মেরু এলাকার কাছাকাছি সমুদ্রে লবণাক্ততার মাত্রা কিছুটা কম। আর বেশি মাত্রায় সূর্যের আলো পেয়ে উত্তপ্ত হওয়ার সুযোগ থাকায় ক্রান্তীয় এলাকার সমুদ্রে লবণাক্ততার মাত্রা কিছুটা বেশি। নদীগুলো বিভিন্ন ধরনের খনিজ সমুদ্রে বয়ে নিয়ে আসে। এর মধ্যে ক্যালসিয়ামের পরিমাণই বেশি। কিন্তু সেগুলো শামুক এবং কোরালের মত সামুদ্রিক প্রাণীর দেহ গঠনে ব্যয়িত হয়ে যায়। অন্যান্য খনিজগুলোও সমুদ্রের জীবজগতের জন্য প্রয়োজনীয়। বেশীমাত্রায় উদ্বৃত্ত থাকে কেবল সোডিয়াম ক্লোরাইড বা খাওয়ার লবণ।

No comments: