December 19, 2016

একজন ব্যক্তি কেন শিক্ষক হন?


“বেশির ভাগ শিক্ষক এই পেশা বেছে নেন কারণ এটা হল এমন একটা পেশা, যা লোকেদেরকে সাহায্য করে। ছেলেমেয়েদের জীবনে বিরাট পরিবর্তন আনার জন্য [শিক্ষকতা হল একটা] অঙ্গীকার।”—শিক্ষক, স্কুল এবং সমাজ
যদিও কিছু শিক্ষক শিক্ষকতাকে খুব সহজ বলে মনে করেন, কিন্তু এই পেশাতে অনেক বাধা আসতে পারে, যেগুলোর মোকাবিলা করতে হয় যেমন, ক্লাসে প্রচুর ছাত্রছাত্রী থাকা, অত্যধিক লেখালেখির কাজ, নিয়মকানুনের অনেক আনুষ্ঠানিকতা, অমনোযোগী ছাত্রছাত্রী এবং কম বেতন। স্পেনের মাদ্রিদের একজন শিক্ষক পেদ্রো বিষয়টাকে এভাবে বলেন: “একজন শিক্ষক হওয়া কখনও সহজ নয়। এর জন্য অনেক আত্মত্যাগের প্রয়োজন। তবুও, অনেক বাধাবিপত্তি থাকা সত্ত্বেও শিক্ষকতাকে আমি ব্যবসায়িক জগতের একটা চাকরির চেয়ে আরও বেশি পরিতৃপ্তিকর কাজ বলে মনে করি।

 
বেশির ভাগ দেশে, শহরের বড় বড় স্কুলগুলোতে এইধরনের সমস্যা আরও বিরাট হতে পারে। মাদকদ্রব্য, অপরাধ, নীতিহীনতা এবং কখনও কখনও বাবামার অবহেলা স্কুলের পরিবেশ এবং নিয়মকানুনের ওপর জোরালো প্রভাব ফেলে। বিদ্রোহী আচরণ খুবই সাধারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারপরও, কেন অনেক যোগ্য লোক শিক্ষক হওয়াটা বেছে নেন?
লিমেরিজ এবং ডায়ানা নিউ ইয়র্ক সিটির শিক্ষক। তারা কিন্ডারগার্টেনের ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে দশ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কাজ করেন। দুজনেই দোভাষী (ইংরেজি-স্প্যানিশ) এবং বিশেষ করে স্পেনীয় ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কাজ করেন। আমাদের প্রশ্ন ছিল. . .
কোন্‌ বিষয়টা একজন শিক্ষককে প্রেরণা দেয়?
লিমেরিজ বলেন: “কোন্‌ বিষয়টা আমাকে প্রেরণা দিয়েছিল? ছেলেমেয়েদের প্রতি আমার ভালবাসা। আমি জানি যে, কিছু ছেলেমেয়েদের চেষ্টায় সাহায্য করার জন্য আমিই হলাম একমাত্র ব্যক্তি।”
ডায়ানা বলেন: “আমি আমার আট বছর বয়সী ভাইপোকে পড়াতাম, যার স্কুলের পড়াশোনায় বিশেষ করে পড়তে অনেক অসুবিধা হতো। তাকে এবং অন্যদেরকে পড়াশোনা করতে দেখা অনেক পরিতৃপ্তিকর অনুভূতি ছিল! তাই আমি শিক্ষক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিই এবং ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিই।”
সচেতন থাক! পত্রিকা অন্যান্য দেশের শিক্ষকদেরকেও একই প্রশ্ন করেছিল আর যে-উত্তর পাওয়া গেছে, সেগুলোর কয়েকটা নমুনা এখানে দেওয়া হল।
ইতালির জুলিয়ানো, যার বয়স ৪০ এর কোঠায়, তিনি বলেন: “আমি এই পেশা বেছে নিই কারণ আমি যখন ছাত্র (ডান দিকে) ছিলাম, তখনই এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি। আমি এটাকে সৃজনশীল এবং অন্যদেরকে উদ্দীপিত করে তোলার বিরাট সুযোগ বলে মনে করি। আমার সেই উৎসাহ, এই পেশায় প্রথম প্রথম যে-সমস্যাগুলো আমি ভোগ করতাম, সেগুলো কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।”
অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের নিক বলেন: “রাসায়নিক গবেষণার ক্ষেত্রে আমার জন্য কাজ পাওয়ার আশা খুব কম ছিল কিন্তু শিক্ষা সংক্রান্ত কাজে অনেক সুযোগ ছিল। তখন থেকে আমি শিক্ষকতা উপভোগ করে আসছি আর ছাত্রছাত্রীরাও আমার শিক্ষকতায় আনন্দ পায় বলে মনে হয়।”
যারা শিক্ষক হওয়া বেছে নিয়েছেন তাদের জন্য বাবামার উদাহরণ প্রায়ই একটা বড় বিষয় হয়েছে। কেনিয়ার উইলিয়াম আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেন: “শিক্ষক হওয়ার আমার যে-ইচ্ছা, সেটার বেশির ভাগই আমার বাবার কাছ থেকে পেয়েছি, যিনি ১৯৫২ সাল থেকে শিক্ষক ছিলেন। আমি ছেলেমেয়েদের মন গড়ে তুলছি, এই বিষয়টা জানাই আমাকে এই পেশায় টিকে থাকতে সাহায্য করেছে।”
এ ছাড়া, কেনিয়ার রোজমেরি আমাদেরকে বলেন: “আমার সবসময় ইচ্ছা ছিল দুঃস্থ লোকেদেরকে সাহায্য করা। তাই দুটো পছন্দ ছিল, নার্স হওয়া নতুবা শিক্ষক হওয়া। শিক্ষক হওয়ার প্রস্তাবটাই প্রথমে আসে। এ ছাড়া, আমি একজন মা হওয়ায় এই পেশার প্রতি আমার ভালবাসা আরও বেড়ে গেছে।”
জার্মানির ডুরেনের বেরটল্টের শিক্ষকতার পিছনে এক ভিন্ন প্রেরণা ছিল: “আমার স্ত্রী আমাকে বুঝতে সাহায্য করে যে, আমি একজন ভাল শিক্ষক হতে পারব।” আর তার কথাই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছিল। তিনি আরও বলেন: “আমার পেশা এখন আমাকে অনেক আনন্দ দেয়। একজন শিক্ষক যদি শিক্ষার গুরুত্ব পুরোপুরি না বোঝেন এবং অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের প্রতি আগ্রহী না হন, তা হলে তার পক্ষে কখনও একজন ভাল, সফল, প্রেরণাদায়ক এবং পরিতৃপ্ত শিক্ষক হওয়া সম্ভব নয়।”
নাকাতসু সিটির একজন জাপানি শিক্ষক মাসাহিরো বলেন: “যে-বিষয়টা আমাকে শিক্ষক হওয়ার জন্য প্রেরণা দিয়েছিল, তা হল আমি যখন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলাম, তখন সেখানে একজন দক্ষ শিক্ষক ছিলেন। তিনি আমাদের অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে শিক্ষা দিতেন। আর যে-মূল কারণটার জন্য আমি আমার এই পেশা চালিয়ে যাচ্ছি সেটা হল যে, ছেলেমেয়েদের আমি ভালবাসি।”
জাপানের ৫৪ বছর বয়সী ইয়োশিয়া একটা ফ্যাক্টরিতে ভাল বেতনের চাকরি করতেন কিন্তু তিনি নিজেকে সেই চাকরি এবং নিয়মিত যাতায়াতের দাস বলে মনে করতেন। “একদিন আমি মনে মনে ভাবতে থাকি যে, ‘আর কতদিন আমি এইরকম জীবনযাপন করব?’ আমি এমন একটা কাজ খোঁজার সিদ্ধান্ত নিই, যে-কাজে জিনিসপত্রের চেয়ে লোকেরা বেশি জড়িত রয়েছে। এই বিষয়ে শিক্ষকতার কোন তুলনা হয় না। আপনি অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কাজ করেন। এটা হল মানবধর্ম।”
রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের ভালেন্টিনাও শিক্ষক হওয়ার বিষয়ে একই উপলব্ধি দেখান। তিনি বলেন: “শিক্ষকতা হল আমার পছন্দের পেশা। ৩৭ বছর ধরে আমি প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতা করছি। আমি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে, বিশেষ করে অল্পবয়স্কদের সঙ্গে কাজ করে আনন্দ পাই। আমি আমার কাজকে ভালবাসি আর তাই এখনও অবসর নিইনি।”
উইলিয়াম আ্যয়ার্স, যিনি নিজেও একজন শিক্ষক, তিনি লেখেন: “লোকেরা শিক্ষকতাকে কর্তব্য বলে মনে করে কারণ তারা ছোট সন্তানদের এবং ছেলেমেয়েদেরকে ভালবাসে বা তাদের সঙ্গে থাকতে, তাদেরকে উন্নতি করতে, বেড়ে উঠতে এবং আরও সমর্থ, উপযুক্ত ও জগতের মধ্যে আরও শক্তিশালী হতে দেখতে ভালবাসে। . . . একজন অন্যদেরকে দান হিসেবে . . . লোকেদের শিক্ষা দেয়। এই জগৎকে আরও ভাল এক জায়গায় পরিণত করার আশা নিয়ে আমি শিক্ষা দিই।”
হ্যাঁ, বিভিন্ন সমস্যা এবং অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও, হাজার হাজার উৎসর্গীকৃত নারী-পুরুষ শিক্ষকতা পেশা বেছে নিচ্ছেন। তারা যে-বড় বড় সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন, সেগুলোর কয়েকটা কী? পরের প্রবন্ধে এই প্রশ্নটা বিবেচনা করা হবে।(g০২ ৩/৮)
[৬ পৃষ্ঠার বাক্স]
শিক্ষক-বাবামার মধ্যে ভাববিনিময় করার জন্য কিছু পরামর্শ
✔ বাবামাদেরকে জানুন। এটা কোন সময়ের অপচয় নয়। পরস্পরের উপকারের জন্য এই সময় দেওয়া হয়। যারা আপনার সবচেয়ে ভাল সহযোগী হতে পারে, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য এটা হল একটা সুযোগ।
✔ বাবামাদের অবস্থা বুঝে সেই মতো কথা বলুন—নিজেকে বড় মনে করবেন না। শিক্ষকদের ভাষা এড়িয়ে চলুন।
✔ ছেলেমেয়েদের সম্বন্ধে কথা বলার সময় গঠনমূলক বিষয় নিয়ে কথা বলুন। দোষ ধরার চেয়ে প্রশংসা করা আরও বেশি কার্যকারী। ছেলেমেয়েদেরকে সফল করে তোলার জন্য বাবামারা কী করতে পারেন, সেই বিষয়ে বুঝিয়ে বলুন।
✔ বাবামাদেরকে বলার সুযোগ দিন এবং মন দিয়ে শুনুন।
✔ ছেলেমেয়েদের বাড়ির পরিবেশ বোঝার চেষ্টা করুন। যদি সম্ভব হয়, তা হলে বাড়িতে গিয়ে দেখা করুন।
✔ পরে আবার কখন আলোচনা করবেন, সেই তারিখ ঠিক করুন। আবার কথা বলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা দেখাবে যে আপনার প্রকৃত আগ্রহ রয়েছে।
পৃথিবীর বিখ্যাত কয়েক জন শিক্ষকের মন্তব্

‘আমার বাবাও একজন শিক্ষক ছিলেন।’—উইলিয়াম, কেনিয়া

“আমি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে . . . কাজ করে আনন্দ পাই।”—ভালেন্টিনা, রাশিয়া


“শিক্ষকতার কোন তুলনা হয় না। আপনি অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কাজ করেন।”—ইয়োশিয়া, জাপান

 আপনার মন্তব্য কী ?

No comments: