শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড, শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না,
যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত- এসব প্রবাদ যাকে ঘিরে রচিত
হয়েছে তিনি হলেন ‘শিক্ষক’। জন্মের পর একটা শিশুর অন্তর থাকে সাদা কাগজের
মতো আর মাতা-পিতার কাছ থেকে প্রাক-পূর্ব প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে এ সাদা
অন্তরে কিছুটা কালি পড়ে। এরপর প্রাক- প্রাথমিক থেকে শুরু করে একেবারে
কর্মজীবন এমনকি মৃত্যুকালীন পূর্ব পর্যন্ত শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে থেকে তার
অন্তরটা অভিজ্ঞতায় ভরপুর করে তুলে। আবার শিক্ষকের কাছ থেকে শিখে আমরা আজ
কথা বলতে পারি, পৃথিবীকে বুঝতে পারছি, জানতে পারছি সমাজকে, উপলব্ধি করতে
পারি ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, উচিত-অনুচিত প্রভৃতি পরিশেষে শাণিত করেছি
আমাদের মেধা আর মননকে। সমাজকে আলোকিত করার, সমাজ থেকে যাবতীয় কুসংস্কার,
কু-প্রথা, অন্ধকার দূর করে এই মহান শিক্ষকরা। এ দিকে লক্ষ রেখেই মনে হয়
এশিয়ার মিসাইল ম্যান খ্যাত সদ্য প্রয়াত ভারতের রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবুল
কালাম আজাদ বলেছিলেন, বাবা, মা আর শিক্ষক এই তিনজন সমাজে পার্থক্য গড়ে দিতে
পারে। প্রয়াত রাষ্ট্রপতি শিক্ষকদের গুরুত্ব উপলব্ধি করেই মনে হয় এ কথাটা
বলেছিলেন আর বলবেন নাই বা কেন একজন শিক্ষার্থী চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ১৬
ঘণ্টাই যে শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে থাকে- এ কথাটা আমরা অস্বীকার করতে পারি
না; এ সময়ে একজন শিক্ষার্থী তার শিক্ষক থেকে চাল-চরণ, আচার-আচরণ, কথা-কাজ,
পোশাক-পরিচ্ছেদ, স্টাইল প্রভৃতি অনুকরণ করতে চেষ্টা করে। কিন্তু এতকিছুর পর
আজ পেশাজীবনে সবচেয়ে অবহেলিত, বঞ্চিত আর নির্যাতিত এবং অপমানিত
সম্প্রদায়ের নাম শিক্ষক সমাজ। আগে শিক্ষকতাকে একটি সম্মানজনক পেশা হিসেবে
বিবেচনা করে এই পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের সর্বক্ষেত্রে সর্বোচ্চ
অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের যে কোনো কাজ কথা প্রভৃতি মানুষ মেনে নিত এবং তাদের
বিশ্বাস করত। কিন্তু আদর্শহীনতার এ যুগে সমাজের বিকৃতরূপ প্রকাশিত হচ্ছে
বিশ্ববাসীর কাছে যার ফলে পিতৃতুল্য এসব শিক্ষককে অপহরণ করে মুক্তপণ আদায়,
খুন, শারীরিক-মানসিকভাবে নির্যাতন, তার মতামতকে দমিয়ে রাখা, আর্থিকভাবে
অসচ্ছল থাকায় এদের সামাজিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না বরং নৈতিক আর আদর্শিক
শিক্ষায় শিক্ষিত বলে এদের যে কোনো কথা বা কাজের মাধ্যমে লাঞ্ছিত করে এদের
সমাজের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার অপচেষ্টা চলছে। আর এ কারণে
দেশের চারদিক থেকে এক ধরনের আর্তনাতের ক্রন্দন সুর বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
গত ৩০ আগস্ট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষকদের ওপর হামলা ও
নির্যাতনের চিত্র থেকে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের কি অবস্থা তা
সহজেই অনুমেয়। দেশের সর্বত্রই শিক্ষকদের ওপর এ ধরনের নির্যাতন হরহামেশাই
ঘটছে আর এসব নির্যাতনের চিত্র কখনো গণমাধ্যমের সাহায্যে আমরা জানতে পারি,
আবার কোনোটি আমরা জানতে পারি না, গণমাধ্যমে আসলে তা হয় আলোচিত বা সমালোচিত,
আর গণমাধ্যমে প্রকাশিত না হলে তা হয় ওই শিক্ষকের কৃতকর্মের উপযুক্ত
শাস্তি। আবার কোনো কোনোটি শিক্ষক নিজে চাকরিচ্যুত আর সম্মান হারানোর ভয়ে
প্রকাশ করেন না কেননা শিক্ষক হওয়ায় সে যে খুবই অসহায়। তাদের যে সমাজের
মানুষের সহানুভূতি আর করুণার ওপর চেয়ে থাকতে হয়, এদের তো সমাজে বিশেষ কোনো
ক্ষমতা নেই। আবার কোনো শিক্ষক প্রতিবাদ করলেও তা শিক্ষকসুলভ আচরণ নয় বলে
তাকে শোকস করে আবার কখনো বহিষ্কার করার ঘটনাও ঘটে যা এখন নিত্যনতুন ঘটনায়
পরিণত হয়েছে। এই বছরের রমজানের শেষ সময়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা তার নিজ হাতে
স্বাধীন করা দেশে কর্মরত একজন সচিবের কাছে গিয়ে যখন বুঝলেন যে তিনি অপমানিত
হচ্ছেন তখন তিনি যন্ত্রণায় কাতর হয়ে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু শিক্ষকের
ক্ষেত্রে আত্মহত্যা করারও যে অধিকার নেই কেননা তিনি তো জীবনের ওপর নৈতিকতার
আর আদর্শের প্রথম স্লোগান আত্মহত্যা মহাপাপ এসব শিখেয়েছিলেন!! ফলে তাকে
আত্মসমর্পণ করে কারাগারে বাস করতে হবে!
এখন সময় এই পেশাকে মহৎ আর সম্মানের পেশা হিসেবে নিত। কিন্তু বর্তমান
ক্ষমতার লোভ, রাজনীতি আর অর্থের দ্বারা পরিচালিত এ সমাজে শিক্ষকদের নেই
কোনো মর্যাদা, নেই কোনো অবস্থান তাই এ সময়ে আর মানুষের করুণা আর সহানুভূতির
দিকে তাকিয়ে থেকে তাদের লাঞ্ছিত হতে হবে। ফলে ছাত্রদের দ্বারা হতে হয়
নির্যাতিত হতে হচ্ছে বারংবার! শাবির ঘটনা ঘটার পর জনপ্রিয় শিক্ষক ড. জাফর
ইকবাল স্যারের প্রতিক্রিয়াটি কার না হৃদয়ে দাগ কাটেনি? এরপর কি হয়েছে তাদের
কোনো বিচার হয়েছে? বহিষ্কারই কি তার উপযুক্ত শাস্তি? এতে করে কি এ ধরনের
ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে? একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষকদের ওপর যদি এ ধরনের হামলা হয় তবে তার থেকে নিচু স্তরের কলেজ বা
স্কুলগুলোতে কি পরিমাণ শিক্ষক নির্যাতিত হচ্ছে তা সহজেই অনুমিত।
শিক্ষকতা পেশা হিসেবে এদের মান-মর্যাদা থাকার কথা অনেক ওপরে এবং এদের এ
বিষয়ে সুরক্ষা পাওয়ার কথা বা এ সংক্রান্ত একটি আইন থাকার কথা কিন্তু
বাংলাদেশে শিক্ষক সুরক্ষা আইন বলে কিছু নেই। এক সময়ে শিক্ষকদের মর্যাদা
নিয়ে কোনো প্রশ্ন ছিল না কেননা ওই সময়ে সবাই শিক্ষককে সম্মান দিত আর এক মহৎ
পেশা হিসেবে বিবেচনা করে এদের সর্বোচ্চ সম্মান দেয়ার চেষ্টা করত কারণ তখন
সমাজে নৈতিকতা আর ধর্মের দ্বারা সমাজে পরিচালিত হতো যেখানে অর্থের আর
ক্ষমতার কোনো দ্ব›দ্ব ছিল না আর এখন অর্থের লোভ, ক্ষমতার অন্ধ দ্ব›দ্ব,
সমাজকে সর্বোপরি জগৎকে করে তুলছে হিংস্র ও স্বার্থপর হিসেবে। আর পেশিশক্তি
ব্যবহারই মনে হয় একমাত্র সমাধান যেহেতু একজন শিক্ষক নৈতিক ও আদর্শিক তাই
তিনি শক্তি ব্যবহার করেতে পারেন না তাই তাকে অপমানিত আর লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে
পথে পথে তা না হলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার অধ্যাপককে শ্লীলতাহানিকরণ
ও নির্যাতন, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হত্যা ও অপহরণ
করে মুক্তপণ দাবি, শাবির ও জাবিতে তাদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে পরিচালিত
আন্দোলনে হামলা আর নির্যাতন করা হবে কেন? সভ্যতার এই যুগে এ ধরনের অসভ্য
কাজ পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে সংঘটিত হয়েছে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
আজ যেসব ছাত্র তাদের পিতৃতুল্য শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলতে দ্বিধাবোধ
করেনা কারণ তাদের মধ্যে নীতি- নৈতিকতা আর আদর্শের অভাব রয়েছে। বাংলাদেশের
শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে হলে এবং শিক্ষকদের ওপর নির্যাতনের মাত্রা কমাতে হলে
শিক্ষক সুরক্ষা আইন বর্তমান সময়ের দাবি। রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক খুন, অপহরণ ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক
লাঞ্ছনা আর নির্যাতনের পরে আওয়াজ উঠেছে শিক্ষক মর্যাদা রক্ষা ও শিক্ষক
সুরক্ষা আইনের। আর দাবি উঠেছে বাংলাদেশের সমগ্র শিক্ষকদের জন্য একটি
স্বতন্ত্র পে-স্কেল গঠন করার। আবার দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা
৩২০০ কলেজের শিক্ষকদের ওপর গভর্নিং বডির নির্যাতন আর স্কুল ম্যানেজিং
কমিটির দৌরাত্ম্যে শিক্ষক সমাজ আজ বড়ই অসহায় আর নিরুপায়। ভারতীয় এজন পণ্ডিত
বলেছিলেন একজন শিক্ষার্থী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১৬ ঘণ্টাই তার শিক্ষকের
তত্ত্বাবধানে থাকে কিন্তু এখন তার পরিবর্তে বলতে হয় একজন শিক্ষার্থী ২৪
ঘণ্টার মধ্যে ১৬ ঘণ্টাই যে ভারতীয় টিভি সিরিয়াল, রাজনীতিতে কর্মসূচি পালন,
অন্ধ লোভ আর ক্ষমতাকে লালন বইয়ের প্রতি মনোযোগ দেয়ার পরিবর্তে ফেসবুকে আর
নীল জগতে মনোযোগী হওয়ায়টাই জরুরি মনে করে; ফলে এখান থেকে প্রাপ্ত
সংবেদনগুলো সে গ্রহণ করে এবং জগতেকে সেভাবে মূল্যায়ন করে। তখন শিক্ষকদের
শেখানো বুলিগুলোকে বাজে কথার তুবড়ি বলে ফেলে দেবে না কেন? আবার রাজনৈতিক
নেতাদের পাতি নেতারাও এসব সম্মানের আশায় এ পেশার লোকদের চোখ রাঙিয়ে আর
বৃদ্ধা আঙুলি প্রদর্শন করে হরহামেশাই করে যাচ্ছে অনৈতিক আর অসামাজিক
কাজসমূহ। সেখানে এসব শিক্ষক মুখ বুঝে সহ্য করা ছাড়া আর কোনো কাজই নেই। এরা
কি শুধুই মানুষের সহানুভূতি আর করুণার ওপর নির্ভর করবে? এদের সামনে কোনো
অনৈতিক ঘটনা ঘটে গেলেও তাদের ওই বিষয়ে মুখ খুলতে মানা!
শিক্ষক শব্দটি শুনলেই একসময় আর্দশ আর সততার ছবি ভেসে আসত আর এখন সব
ক্ষেত্রে শিক্ষকের মাধ্যমে করানো হচ্ছে যাবতীয় অনৈতিক কাজ। আবার শিক্ষক
সরাসরি কোনো অনৈতিক কাজের সঙ্গে জড়িত না হলেও তার সামনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন
অসামাজিক ঘটনার বিরূপ ফল তার অন্তরে দাগ কাটে কেননা অন্যায় যে করে আর যে
সহে উভয়ই ঘৃণ্যতম প্রভুর তরে। এক সময়ে শিক্ষকদের মর্যাদা নিয়ে কোনো প্রশ্ন
ছিল না কেননা ওই সময়ে সবাই শিক্ষককে সম্মান দিত আর এক মহৎ পেশা হিসেবে
বিবেচনা করে এদের সর্বোচ্চ সম্মান দেয়ার চেষ্টা করত কারণ তখন সমাজে
নৈতিকতা আর ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা সমাজ পরিচালিত হতো যেখানে অর্থের আর
ক্ষমতার কোনো দ্ব›দ্ব ছিল না আর এখন অর্থের লোভ, ক্ষমতার অন্ধ দ্ব›দ্ব,
সমাজকে সর্বোপরি জগৎকে করে তুলছে হিংস্র। আর পেশিশক্তি ব্যবহারই মনে হয়
একমাত্র সমাধান যেহেতু একজন শিক্ষক নৈতিক ও আদর্শিক তাই তিনি শক্তি ব্যবহার
করেতে পারেন না তাই তাকে অপমানিত আর লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে পথে পথে। আমরা আশা
করছি, বর্তমানে আন্দোলনরত শিক্ষকদের দাবি আদায়ে সরকার সচেষ্ট হবেন এবং
শিক্ষক সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করে এদের জন্য স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো দাঁড়
করাবেন।