একটি ছেলে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে সেটা জানলে আমার কিশোরবেলায় যে অনুভূতি হত সেগুলো এরকম:
১. ছেলেটি ইংরেজি জানে। ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। (ইংরেজি জানা তখন একটা মারাত্মক ব্যপার ছিল। ইংরেজি জানা মানেই শিক্ষিত!)
২. সে ধনী পরিবারের সন্তান এবং সে স্মার্ট।
৩. সে আমার আশাপাশের কেউ নয়। আমার সীমানার বাইরে তার বসবাস। তার সঙ্গে আমার সাবলীল কোনো সম্পর্ক হতে পারেনা!
আরেকটু বড় হয়ে, একরম একটি ছেলে দেখলে আমার ধারনা হত,
১. এই ব্যাটা বহুৎ ঢং করবে!
২. একে একটু জোরে ধমক দিলে সে কেঁদে ফেলবে!
৩. এটি একটি ফার্মের মুরগি!
কলেজ/ভার্সিটিতে পড়ার সময় আমার ধারনা এরকম রুপ নিলো,
১. ইংলিশ মিডিয়াম পড়ুয়ারা একটা আলোদা গোত্র/গোষ্ঠীর লোক।
২. এরা এই দেশের আপনজন নয়। এই দেশের মানুষের আপন নয়। এই দেশ, মানুষ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে এদের সম্পর্ক কেবলই ব্যাবসায়িক!
অন্তত দ্বিতীয় কথাটি নিঃসন্দেহে বিরাট সরলীকরণ! জনসমক্ষে এরকম কিছু বলা খানিকটা অপরাধ! কিন্তু একটি ব্যপার মনে রাখা দরকার, আমি এই দেশের খুব সাধারণ নিন্মবিত্ত পরিবারের ছেলে। আমি নিজেকে সংখ্যাগরিষ্টের একজন বলে বিশ্বাস করি। অন্তত এই বিষয়ে আমার চিন্তা-ভাবনা এবং এদেশের একটা বড় অংশের চিন্তাভাবনা একরকম। আমাকে কেউ ব্যক্তিগতভাবে কখনো বলে দেয়নি ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেমেয়েরা কেমন। আমি এই ধারনাটা পেয়েছি আমার পরিবেশ থেকে। আমি এই ধারনা পেয়েছি যে অল্প খানিকটা নিজে দেখেছি তার দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে!
কেবল আমি নই। আমার খুব কাছের বন্ধুমহলে দরিদ্র এবং উচ্চমধ্যবিত্ত দুই অংশেরই ছেলেমেয়েরা ছিল। এবং ইংলিশ মিডিয়াম পড়ুয়াদের বিষয়ে আমাদের সবার মানসিকতার মোটামুটি মিল ছিল বলে জানি। আমি এবং আমরা যদি দেশের সংখ্যাগরিষ্টের অংশ হয়ে থাকি, তাহলে কোনো সন্দেহ নেই, আমাদের সঙ্গে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলেমেয়েদের দূরত্ব অনেক। এবং আমরা কেউই এই সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে খুব ভালো চোখে দেখিনা।
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ুয়াদের আমি ঢালাওভাবে দোষ দিতে পারিনা। বিশেষত যারা শিশু অথবা কিশোর তাদেরকে তো নয়ই! একটি বিশেষ পরিবেশে বেড়ে উঠলে কোনো ব্যক্তির মানসিকতা যে সেই পরিবেশের দ্বারা প্রভাবিত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারো দোষ হয়ে থাকলে সেটি তাই সবার আগে এই শিক্ষাব্যবস্থার এবং এর পৃষ্ঠপোষকদের।
বাংলাদেশে কেন একটি ইংরেজি ভাষার শিক্ষা ব্যবস্থা থাকবে? হিসেবে ইংরেজি শেখার প্রয়োজনীয়তা আছে। সেই ইংরেজি আমরা স্কুলেই শিখে থাকি। কিন্তু ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে গ্রহন করার এই মানসিকতাটা আমাদের মাঝে কীভাবে এলো! আফ্রিকার কিছু কিছু দেশের মানুষের ভাষা ইংরেজি, কিছু মানুষের ভাষা ফরাসি। তাদের মাতৃভাষা ইংরেজি অথবা ফরাসি না হলেও এই ভাষাকে তাদের গ্রহন করতে হয়েছে দায়ে পড়ে! বাধ্য হয়ে! আমাদের দায়টা কোথায়? এটি আমাদের দায়, নাকি দৈন্যতা! সাহেবদের ভাষায় শিখলে সাহেব হওয়া যাবে, সেজন্য আমরা ইংরেজিকে ভাষা হিসেবে গ্রহন করব?
গ্রহনযোগ্য একটা যুক্তি হতে পারে পড়াশোনার মান। কিন্তু সেটি কেন হবে? একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে কেন দুই মানের শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে? যদি ইংরেজি মাধ্যমের পড়াশোনার মান ভালো হয় তাহলে যে ছেলেটি বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করছে তার অপরাধ কী! সে কেন তার রাষ্ট্রের কাছ থেকে সর্বোচ্চ মানের শিক্ষার সেবা পাবে না? এই দেশে কেন দুটি স্কুল গড়ে উঠবে পাশাপাশি, যার একটিতে পড়াশোনার মান ভালো আর একটিতে খারাপ। যার আর্থিক ক্ষমতা রয়েছে সে ভালো শিক্ষা পাবে, আর যে দরিদ্র সে পাবে নিন্মমানের শিক্ষার সেবা!? রাষ্ট্রের এই অবস্থানটি কেমন?
আমার জানামতে অনেক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পড়াশোনার পাঠ্যক্রম আমাদের জাতীয় পাঠ্যক্রম নয়। সেই পাঠ্যক্রম আমদানী হয় ইউরোপ, আমেরিকা থেকে (মূলত বৃটিশ এবং আমেরিকান)। আমি বলছিনা, ইউরোপ আমেরিকার পাঠ্যক্রম খারাপ। কিন্তু একটি দেশের শিক্ষার পাঠ্যক্রম সেই দেশের সামাজিকতা, সংস্কৃতি আর মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে হওয়া প্রয়োজন। সেসব মিলিয়েই যদি ইউরোপীয়/আমেরিকান পাঠ্যক্রম আমাদের জন্য উন্নত হয়ে থাকে তাহলে সেটি কেন সারাদেশের স্কুলে জন্য প্রযোজ্য হবে না? একটি আলাদা ধরনের স্কুল তৈরি করে সেখানে কেন সেই পাঠ্যক্রম মেনে পড়ানো হবে? আমাদের রাষ্ট্র কি মনে করে ইংরেজি মাধ্যমের পড়াশোনা উন্নত? সেরকম হলে রাষ্ট্রই পারে সেই উন্নত শিক্ষা সেবা সবার জন্য নির্দিষ্ট করে দিতে। যদি সেরকম না হয়, তাহলে রাষ্ট্র কেন এই শ্রেনীর শিক্ষা ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে?
আমি সব স্কুলের ব্যপারে জানি না। কিন্তু যতটুকু জেনেছি তাতে অনেক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের পরিবেশই এই দেশ এবং সংস্কৃতির থেকে বহুদূরের। এই দেশের এবং সংস্কৃতির সঙ্গে তার সর্ম্পক নেই বললেই চলে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থীরা এদেশের ইতিহাসও পড়ে না! ব্রিটিশ পাঠ্যক্রমে যারা পড়ে তারা পড়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির বীরত্বের ইতিহাস! আছে সামাজিক বিজ্ঞানের অংশে ৭১'র নামমাত্র উল্লেখ! বাংলা একটিমাত্র বিষয় আছে বলে জেনেছি! সেখানে তারা নির্দিষ্ট কিছু গল্প কবিতা পড়তে পায়!
একটি দেশের শিশুরা যে শিক্ষা লাভ করে সেটি বস্তুত সেই জাতির শিক্ষার ধরন হয়ে ওঠে। আমাদের যে শিশুরা তাদের ভাষা আর সংস্কৃতি বিবর্জিত শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে তারা যে এই জাতির অংশ হয়ে উঠবে না, সেটাতে তো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়! আর যদি এই জাতির সব শিশুই এই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠে তাহলে কী এই জাতির পরিচয়টাই বদলে যাবেনা?
একজন সহসচল জানালেন, অক্সফোর্ড ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে বাংলা বলা নিষেধ! ধারনা করছি এরকম স্কুলগুলোতে ইংরেজিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিন্তা-ভাবনাও ইংরেজিতে করতে হয়! সেই ইংরেজি ভাবনা নিয়ে বেড়ে ওঠা শিশুরা যে এই দেশের কেউ হয়ে ওঠেনা সেটা বুঝতে বেগ পেতে হয়না! এই শিশুরা বাংলা ভাষাকে, বাঙালি সংস্কৃতিকে, বাঙালি মূল্যবোধকে ভালোবাসতে পারে? তারা কী এই দেশটিকে ভালোবাসে? এদেশের মানুষকে? তারা কী এই দেশটিকে নোংরা, অনুন্নত, নিগারের দেশ ভেবে নেয়? এই প্রশ্নটির জবাব আমি জানিনা। এই প্রশ্নটির জবাব জানতে আমি খুবই আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করে আছি!
ভালো লেগেছে, যখন একজন সহসচলের কাছে জেনেছি, এই দেশেরই কিছু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে অনেকটা বাংলা পরিবেশও রয়েছে। সেখানে বাঙালি সংস্কৃতির ছোঁয়াও রয়েছে! এই বিষয়টিও অবশ্য আমাকে খুব দুঃশ্চিন্তামুক্ত করতে পারেনি। যে কথাটি আগে বলেছি, সেই কথাটি আবারও বলি, ভাষা হিসেবে ইংরেজি শেখার প্রয়োজনিয়তা আছে। কিন্তু শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার বাইরে অন্য কোনো ভাষাকে কেন গ্রহন করা হবে? এরকম আচরণ কি একটি হীনমন্য এবং একই সঙ্গে বোকা জাতির পরিচায়ক নয়!
একটি ব্যপার খুব স্পষ্ট বলে রাখা প্রয়োজন, ইংরেজিতে শিক্ষা গ্রহন আধুনিকতা নয়! উন্নতির জন্য সেটির প্রয়োজন নেই! সেটি বরং একটি জাতিকে হীনমন্য এবং পশ্চাদপদ করে রাখবে! বিশ্বে ইংরেজরাই কেবল শিক্ষিত এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে আধুনিক নয়! জার্মানরা তাদের ভাষায় শেখে, স্প্যানিশরা তাদের ভাষায় শেখে, ইতালিয়রা তাদের ভাষায় শেখে (আমি জেনেছি সেখানে ইংরেজিতে তো বটেই, যে কোনো বিদেশী ভাষায় পড়ানো নিষেধ!), দিতে চাইলে উদাহরণের অভাব হবেনা! এইসব জাতি অনুন্নত নয়, এরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রথম কাতারের! এইসব দেশও উন্নত বিশ্বেরই দেশ! কিন্তু সেটি আমার বক্তব্য নয়, এইসব জাতি যদি উন্নত না হতো, তারমানেই কী আমরা আমাদের ভাষা সংস্কৃতি ছেড়ে লাফ দিয়ে সাহেবী ভাষা-সংস্কৃতির মদ পান করে সাহেব হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করতাম? সেটি কি আদৌ সম্ভব?! আমরা কী ভেবে দেখেছি এই চিন্তাটাই কতটা হাস্যকর, কতটা অবৈজ্ঞানিক?! (আফ্রিকার অনেক দেশেই পড়াশোনা/দৈনন্দিন কথাবলার ভাষা ইংরেজি, তারা কিন্তু বিশ্বের সবচে অভাগা এবং পশ্চাদপদ জাতিদের মধ্য পড়ে!)
ইংরেজি শিক্ষাও আধুনিকতার পরিচায়ক নয়। যে ইংরেজি বলতে পারে সে বড়জোর একটি বিদেশী ভাষা জানার কৃতিত্বের দাবীদার হতে পারে! সেই ছাড়া তার আর কোনো মাহাত্ম্য নেই! এমনিতে মাতৃভাষার বাইরে অন্য ভাষা জানা নিশ্চয়ই ভালো, কিন্তু খুব আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ শুদ্ধ বাংলা জানেনা! আরো অবাক করা ব্যপার হলো বাংলা না জানাটা অনেকের কাছেই সামাজিক মর্যাদার বিষয়! এই শিক্ষাটি এরা তাদের পরিবার, তাদের পরিমণ্ডল থেকেই পায়। এই কথাটি তাই কেবল ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থী নয়, তাদের পরিবারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেসব পরিবারের একটি বড় অংশ ৮০'র দশকে আচমকা অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে! যে পরিবারগুলোর শিক্ষার কোনো ইতিহাস কখনোই ছিলনা! এই শ্রেণীর কাছে ইংরেজি কথা বলতে পারা যতটা না স্মার্টনেস, বাংলা না বলতে পারা তার চাইতে বেশি স্মার্টনেস! এদেরই একটা অংশ এইসব ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের পৃষ্ঠপোষক! এদের আগ্রহতেই পাঠ্যক্রম আর সংস্কৃতি আমদানী হয়েছে এসব স্কুলের। সমাজের বিত্তবান শ্রেণীর পরিচায়ক সেই ধারাটিই এখনো চালিয়ে নিচ্ছে এসব স্কুল! বিত্তবান অথবা উঁচুতলার বাসিন্দাদের একজন হতে অনেকেই অনেক কষ্ট করে হলেও নিজেদেরকে যোগ করে নিচ্ছেন এই অংশে!
সাধারণের চোখে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলেমেয়েরা তাই সমাজের সুবিধাভোগী বিত্তবান গোষ্ঠীর অন্তর্গত! একজন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছেলেকে দেখেলেই 'টাকাওয়ালা এবং দূর্ণীতিবাজের' ছেলে ধরে নেয়ার মানসিকতা আমাদের মাঝে এসেছে সেই বোধ থেকেই!
স্কুলের শিক্ষার পরেও সামাজিক মর্যাদারক্ষার শ্রেণী থেকে উঠে আসা ছেলেমেয়েরা এই সমাজে নিজস্ব বলয় তৈরি করে প্রায় বিচ্ছিন্ন থেকেও টিকে যাচ্ছে হয়তো, কিন্তু এই দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সহজে টিকতে পারছেনা! (উদাহরণ হিসেবে বলি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা বুয়েটের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই শ্রেণীর প্রতিনিধি নেই বললেই চলে! এসব ছেলেমেয়েদের বড় অংশটির শেষ পর্যন্ত উপায় হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অথবা বিদেশ!
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, অথবা এই শিক্ষাব্যবস্থা প্রসঙ্গে সবমিলিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন তৈরি হয়,
১. বাঙালি শিশুরা কেন ইংরেজিতে শিখবে?
২. (যদি প্রযোজ্য হয় তাহলে) বাঙালি শিশুরা কেন ভিন্ন সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠবে?
৩. প্রথাগত বাংলা মাধ্যমের চাইতে যদি অন্য কোন মাধ্যম উন্নত/ভালো হয়ে থাকে তাহলে সেই সুবিধা দেশের সব শিশুর জন্য না হয়ে কেন কেবল বিশেষ কোন গোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ হবে?
৪. যদি সত্যিই এই শ্রেণীটি বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতি বিবর্জিত হয়ে বেড়ে ওঠে তাহলে তাদের কাছ থেকে এই দেশ কী আশা করতে পারে?
৫. সাধারণের সঙ্গে এই শ্রেণীটির যে দূরত্ব সেটি কি সুস্থ এবং স্বাভাবিক?
৬. বেড়ে ওঠার পর বিস্তৃত সমাজে কি এই শিশুরা নিজেদেরকে মিলিয়ে নিতে পারে?
৮. দৃশ্যত যে বিভেদ বাংলা, ইংরেজি আর আরবী মাধ্যমে শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে, সেটি কী ভবিষ্যতে কোনো সামাজিক/রাষ্ট্রীয় টানাপোড়েনের জন্ম দিতে পারে?
৯. যদি করে, তাহলে একটি সুস্থ সমাজের ভেতরেই ভিন্ন একটি গোষ্ঠীর জন্ম দিয়ে চলা এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাষ্ট্র কেন স্বীকৃতি দিয়ে চলছে?
লেখাটি শুরু করেছিলাম, আমার ব্যক্তিগত ধারনার কথা বলে। সেখানে যতটুকু সরলীকরণ রয়েছে সেই দায় আমার। তবে আমি বিশ্বাস করতে চাই, ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীরাও আমাদের একজন। আমি বিশ্বাস করতে চাই, যে ছেলেটিকে দেখে আমি আমার দেশের মাটি-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা ভিন্নগ্রহের বাসিন্দা ভেবেছি, সে আসলে এই দেশেরই খুব কাছের মানুষ! কিন্তু তেমনটা চাইলেই ভাবতে পারা যায়না। যে প্রশ্নগুলোর কথা আমি বলেছি সেই প্রশ্নগুলো আরো অনেকের মনেই জেগেছে, সন্দেহ নেই! রাষ্ট্রও এই বিষয়ে মৃত্যুর মতো নিরব! সেটিও কখনোই সুস্থতার লক্ষণ নয়। আমাদের কথা বলার প্রয়োজন, আলোচনার প্রয়োজন, অলীক ধারনা তৈরি হলে তা ভেঙে দেয়া প্রয়োজন। সমস্যা থাকলে মিটিয়ে নেয়ার প্রয়োজন। এবং সেটি প্রয়োজন এখনই।
একই সঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন, যদি সত্যিই ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষাব্যবস্থা সামঞ্জস্যহীন কিছু হয়ে থাকে তাহলে সেখানে যেসব শিশুরা পড়ছে, তাদেরকে এই সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জসস্যহীন সেই ব্যবস্থায় ফেলে দেয়ার দায় আমাদেরই! নির্বুদ্ধিতার সেই দায় আমাদেরকেই মেটাতে হবে। আমাদের জাতির মেরুদণ্ড কতটা ঋজু আর সুদৃঢ় হবে সেটা র্নিভর করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার উপরেই! আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় তাই কোনো অন্ধকার/অসামঞ্জস্য থাকার সুযোগ নেই!
কমেন্টে বেশী দিয়েন গাইল দিয়েন না ভাই।
১. ছেলেটি ইংরেজি জানে। ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। (ইংরেজি জানা তখন একটা মারাত্মক ব্যপার ছিল। ইংরেজি জানা মানেই শিক্ষিত!)
২. সে ধনী পরিবারের সন্তান এবং সে স্মার্ট।
৩. সে আমার আশাপাশের কেউ নয়। আমার সীমানার বাইরে তার বসবাস। তার সঙ্গে আমার সাবলীল কোনো সম্পর্ক হতে পারেনা!
আরেকটু বড় হয়ে, একরম একটি ছেলে দেখলে আমার ধারনা হত,
১. এই ব্যাটা বহুৎ ঢং করবে!
২. একে একটু জোরে ধমক দিলে সে কেঁদে ফেলবে!
৩. এটি একটি ফার্মের মুরগি!
কলেজ/ভার্সিটিতে পড়ার সময় আমার ধারনা এরকম রুপ নিলো,
১. ইংলিশ মিডিয়াম পড়ুয়ারা একটা আলোদা গোত্র/গোষ্ঠীর লোক।
২. এরা এই দেশের আপনজন নয়। এই দেশের মানুষের আপন নয়। এই দেশ, মানুষ এবং সংস্কৃতির সঙ্গে এদের সম্পর্ক কেবলই ব্যাবসায়িক!
অন্তত দ্বিতীয় কথাটি নিঃসন্দেহে বিরাট সরলীকরণ! জনসমক্ষে এরকম কিছু বলা খানিকটা অপরাধ! কিন্তু একটি ব্যপার মনে রাখা দরকার, আমি এই দেশের খুব সাধারণ নিন্মবিত্ত পরিবারের ছেলে। আমি নিজেকে সংখ্যাগরিষ্টের একজন বলে বিশ্বাস করি। অন্তত এই বিষয়ে আমার চিন্তা-ভাবনা এবং এদেশের একটা বড় অংশের চিন্তাভাবনা একরকম। আমাকে কেউ ব্যক্তিগতভাবে কখনো বলে দেয়নি ইংলিশ মিডিয়ামের ছেলেমেয়েরা কেমন। আমি এই ধারনাটা পেয়েছি আমার পরিবেশ থেকে। আমি এই ধারনা পেয়েছি যে অল্প খানিকটা নিজে দেখেছি তার দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে!
কেবল আমি নই। আমার খুব কাছের বন্ধুমহলে দরিদ্র এবং উচ্চমধ্যবিত্ত দুই অংশেরই ছেলেমেয়েরা ছিল। এবং ইংলিশ মিডিয়াম পড়ুয়াদের বিষয়ে আমাদের সবার মানসিকতার মোটামুটি মিল ছিল বলে জানি। আমি এবং আমরা যদি দেশের সংখ্যাগরিষ্টের অংশ হয়ে থাকি, তাহলে কোনো সন্দেহ নেই, আমাদের সঙ্গে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলেমেয়েদের দূরত্ব অনেক। এবং আমরা কেউই এই সংখ্যালঘু গোষ্ঠীকে খুব ভালো চোখে দেখিনা।
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ুয়াদের আমি ঢালাওভাবে দোষ দিতে পারিনা। বিশেষত যারা শিশু অথবা কিশোর তাদেরকে তো নয়ই! একটি বিশেষ পরিবেশে বেড়ে উঠলে কোনো ব্যক্তির মানসিকতা যে সেই পরিবেশের দ্বারা প্রভাবিত হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারো দোষ হয়ে থাকলে সেটি তাই সবার আগে এই শিক্ষাব্যবস্থার এবং এর পৃষ্ঠপোষকদের।
বাংলাদেশে কেন একটি ইংরেজি ভাষার শিক্ষা ব্যবস্থা থাকবে? হিসেবে ইংরেজি শেখার প্রয়োজনীয়তা আছে। সেই ইংরেজি আমরা স্কুলেই শিখে থাকি। কিন্তু ভাষা হিসেবে ইংরেজিকে গ্রহন করার এই মানসিকতাটা আমাদের মাঝে কীভাবে এলো! আফ্রিকার কিছু কিছু দেশের মানুষের ভাষা ইংরেজি, কিছু মানুষের ভাষা ফরাসি। তাদের মাতৃভাষা ইংরেজি অথবা ফরাসি না হলেও এই ভাষাকে তাদের গ্রহন করতে হয়েছে দায়ে পড়ে! বাধ্য হয়ে! আমাদের দায়টা কোথায়? এটি আমাদের দায়, নাকি দৈন্যতা! সাহেবদের ভাষায় শিখলে সাহেব হওয়া যাবে, সেজন্য আমরা ইংরেজিকে ভাষা হিসেবে গ্রহন করব?
গ্রহনযোগ্য একটা যুক্তি হতে পারে পড়াশোনার মান। কিন্তু সেটি কেন হবে? একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশে কেন দুই মানের শিক্ষাব্যবস্থা থাকবে? যদি ইংরেজি মাধ্যমের পড়াশোনার মান ভালো হয় তাহলে যে ছেলেটি বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করছে তার অপরাধ কী! সে কেন তার রাষ্ট্রের কাছ থেকে সর্বোচ্চ মানের শিক্ষার সেবা পাবে না? এই দেশে কেন দুটি স্কুল গড়ে উঠবে পাশাপাশি, যার একটিতে পড়াশোনার মান ভালো আর একটিতে খারাপ। যার আর্থিক ক্ষমতা রয়েছে সে ভালো শিক্ষা পাবে, আর যে দরিদ্র সে পাবে নিন্মমানের শিক্ষার সেবা!? রাষ্ট্রের এই অবস্থানটি কেমন?
আমার জানামতে অনেক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পড়াশোনার পাঠ্যক্রম আমাদের জাতীয় পাঠ্যক্রম নয়। সেই পাঠ্যক্রম আমদানী হয় ইউরোপ, আমেরিকা থেকে (মূলত বৃটিশ এবং আমেরিকান)। আমি বলছিনা, ইউরোপ আমেরিকার পাঠ্যক্রম খারাপ। কিন্তু একটি দেশের শিক্ষার পাঠ্যক্রম সেই দেশের সামাজিকতা, সংস্কৃতি আর মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে হওয়া প্রয়োজন। সেসব মিলিয়েই যদি ইউরোপীয়/আমেরিকান পাঠ্যক্রম আমাদের জন্য উন্নত হয়ে থাকে তাহলে সেটি কেন সারাদেশের স্কুলে জন্য প্রযোজ্য হবে না? একটি আলাদা ধরনের স্কুল তৈরি করে সেখানে কেন সেই পাঠ্যক্রম মেনে পড়ানো হবে? আমাদের রাষ্ট্র কি মনে করে ইংরেজি মাধ্যমের পড়াশোনা উন্নত? সেরকম হলে রাষ্ট্রই পারে সেই উন্নত শিক্ষা সেবা সবার জন্য নির্দিষ্ট করে দিতে। যদি সেরকম না হয়, তাহলে রাষ্ট্র কেন এই শ্রেনীর শিক্ষা ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে?
আমি সব স্কুলের ব্যপারে জানি না। কিন্তু যতটুকু জেনেছি তাতে অনেক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের পরিবেশই এই দেশ এবং সংস্কৃতির থেকে বহুদূরের। এই দেশের এবং সংস্কৃতির সঙ্গে তার সর্ম্পক নেই বললেই চলে। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থীরা এদেশের ইতিহাসও পড়ে না! ব্রিটিশ পাঠ্যক্রমে যারা পড়ে তারা পড়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির বীরত্বের ইতিহাস! আছে সামাজিক বিজ্ঞানের অংশে ৭১'র নামমাত্র উল্লেখ! বাংলা একটিমাত্র বিষয় আছে বলে জেনেছি! সেখানে তারা নির্দিষ্ট কিছু গল্প কবিতা পড়তে পায়!
একটি দেশের শিশুরা যে শিক্ষা লাভ করে সেটি বস্তুত সেই জাতির শিক্ষার ধরন হয়ে ওঠে। আমাদের যে শিশুরা তাদের ভাষা আর সংস্কৃতি বিবর্জিত শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে তারা যে এই জাতির অংশ হয়ে উঠবে না, সেটাতে তো কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়! আর যদি এই জাতির সব শিশুই এই শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ওঠে তাহলে কী এই জাতির পরিচয়টাই বদলে যাবেনা?
একজন সহসচল জানালেন, অক্সফোর্ড ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে বাংলা বলা নিষেধ! ধারনা করছি এরকম স্কুলগুলোতে ইংরেজিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিন্তা-ভাবনাও ইংরেজিতে করতে হয়! সেই ইংরেজি ভাবনা নিয়ে বেড়ে ওঠা শিশুরা যে এই দেশের কেউ হয়ে ওঠেনা সেটা বুঝতে বেগ পেতে হয়না! এই শিশুরা বাংলা ভাষাকে, বাঙালি সংস্কৃতিকে, বাঙালি মূল্যবোধকে ভালোবাসতে পারে? তারা কী এই দেশটিকে ভালোবাসে? এদেশের মানুষকে? তারা কী এই দেশটিকে নোংরা, অনুন্নত, নিগারের দেশ ভেবে নেয়? এই প্রশ্নটির জবাব আমি জানিনা। এই প্রশ্নটির জবাব জানতে আমি খুবই আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করে আছি!
ভালো লেগেছে, যখন একজন সহসচলের কাছে জেনেছি, এই দেশেরই কিছু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে অনেকটা বাংলা পরিবেশও রয়েছে। সেখানে বাঙালি সংস্কৃতির ছোঁয়াও রয়েছে! এই বিষয়টিও অবশ্য আমাকে খুব দুঃশ্চিন্তামুক্ত করতে পারেনি। যে কথাটি আগে বলেছি, সেই কথাটি আবারও বলি, ভাষা হিসেবে ইংরেজি শেখার প্রয়োজনিয়তা আছে। কিন্তু শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার বাইরে অন্য কোনো ভাষাকে কেন গ্রহন করা হবে? এরকম আচরণ কি একটি হীনমন্য এবং একই সঙ্গে বোকা জাতির পরিচায়ক নয়!
একটি ব্যপার খুব স্পষ্ট বলে রাখা প্রয়োজন, ইংরেজিতে শিক্ষা গ্রহন আধুনিকতা নয়! উন্নতির জন্য সেটির প্রয়োজন নেই! সেটি বরং একটি জাতিকে হীনমন্য এবং পশ্চাদপদ করে রাখবে! বিশ্বে ইংরেজরাই কেবল শিক্ষিত এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে আধুনিক নয়! জার্মানরা তাদের ভাষায় শেখে, স্প্যানিশরা তাদের ভাষায় শেখে, ইতালিয়রা তাদের ভাষায় শেখে (আমি জেনেছি সেখানে ইংরেজিতে তো বটেই, যে কোনো বিদেশী ভাষায় পড়ানো নিষেধ!), দিতে চাইলে উদাহরণের অভাব হবেনা! এইসব জাতি অনুন্নত নয়, এরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রথম কাতারের! এইসব দেশও উন্নত বিশ্বেরই দেশ! কিন্তু সেটি আমার বক্তব্য নয়, এইসব জাতি যদি উন্নত না হতো, তারমানেই কী আমরা আমাদের ভাষা সংস্কৃতি ছেড়ে লাফ দিয়ে সাহেবী ভাষা-সংস্কৃতির মদ পান করে সাহেব হওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করতাম? সেটি কি আদৌ সম্ভব?! আমরা কী ভেবে দেখেছি এই চিন্তাটাই কতটা হাস্যকর, কতটা অবৈজ্ঞানিক?! (আফ্রিকার অনেক দেশেই পড়াশোনা/দৈনন্দিন কথাবলার ভাষা ইংরেজি, তারা কিন্তু বিশ্বের সবচে অভাগা এবং পশ্চাদপদ জাতিদের মধ্য পড়ে!)
ইংরেজি শিক্ষাও আধুনিকতার পরিচায়ক নয়। যে ইংরেজি বলতে পারে সে বড়জোর একটি বিদেশী ভাষা জানার কৃতিত্বের দাবীদার হতে পারে! সেই ছাড়া তার আর কোনো মাহাত্ম্য নেই! এমনিতে মাতৃভাষার বাইরে অন্য ভাষা জানা নিশ্চয়ই ভালো, কিন্তু খুব আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ শুদ্ধ বাংলা জানেনা! আরো অবাক করা ব্যপার হলো বাংলা না জানাটা অনেকের কাছেই সামাজিক মর্যাদার বিষয়! এই শিক্ষাটি এরা তাদের পরিবার, তাদের পরিমণ্ডল থেকেই পায়। এই কথাটি তাই কেবল ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থী নয়, তাদের পরিবারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেসব পরিবারের একটি বড় অংশ ৮০'র দশকে আচমকা অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে! যে পরিবারগুলোর শিক্ষার কোনো ইতিহাস কখনোই ছিলনা! এই শ্রেণীর কাছে ইংরেজি কথা বলতে পারা যতটা না স্মার্টনেস, বাংলা না বলতে পারা তার চাইতে বেশি স্মার্টনেস! এদেরই একটা অংশ এইসব ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের পৃষ্ঠপোষক! এদের আগ্রহতেই পাঠ্যক্রম আর সংস্কৃতি আমদানী হয়েছে এসব স্কুলের। সমাজের বিত্তবান শ্রেণীর পরিচায়ক সেই ধারাটিই এখনো চালিয়ে নিচ্ছে এসব স্কুল! বিত্তবান অথবা উঁচুতলার বাসিন্দাদের একজন হতে অনেকেই অনেক কষ্ট করে হলেও নিজেদেরকে যোগ করে নিচ্ছেন এই অংশে!
সাধারণের চোখে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলেমেয়েরা তাই সমাজের সুবিধাভোগী বিত্তবান গোষ্ঠীর অন্তর্গত! একজন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছেলেকে দেখেলেই 'টাকাওয়ালা এবং দূর্ণীতিবাজের' ছেলে ধরে নেয়ার মানসিকতা আমাদের মাঝে এসেছে সেই বোধ থেকেই!
স্কুলের শিক্ষার পরেও সামাজিক মর্যাদারক্ষার শ্রেণী থেকে উঠে আসা ছেলেমেয়েরা এই সমাজে নিজস্ব বলয় তৈরি করে প্রায় বিচ্ছিন্ন থেকেও টিকে যাচ্ছে হয়তো, কিন্তু এই দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সহজে টিকতে পারছেনা! (উদাহরণ হিসেবে বলি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা বুয়েটের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই শ্রেণীর প্রতিনিধি নেই বললেই চলে! এসব ছেলেমেয়েদের বড় অংশটির শেষ পর্যন্ত উপায় হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অথবা বিদেশ!
ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, অথবা এই শিক্ষাব্যবস্থা প্রসঙ্গে সবমিলিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন তৈরি হয়,
১. বাঙালি শিশুরা কেন ইংরেজিতে শিখবে?
২. (যদি প্রযোজ্য হয় তাহলে) বাঙালি শিশুরা কেন ভিন্ন সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠবে?
৩. প্রথাগত বাংলা মাধ্যমের চাইতে যদি অন্য কোন মাধ্যম উন্নত/ভালো হয়ে থাকে তাহলে সেই সুবিধা দেশের সব শিশুর জন্য না হয়ে কেন কেবল বিশেষ কোন গোষ্ঠীর জন্য বরাদ্দ হবে?
৪. যদি সত্যিই এই শ্রেণীটি বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতি বিবর্জিত হয়ে বেড়ে ওঠে তাহলে তাদের কাছ থেকে এই দেশ কী আশা করতে পারে?
৫. সাধারণের সঙ্গে এই শ্রেণীটির যে দূরত্ব সেটি কি সুস্থ এবং স্বাভাবিক?
৬. বেড়ে ওঠার পর বিস্তৃত সমাজে কি এই শিশুরা নিজেদেরকে মিলিয়ে নিতে পারে?
৮. দৃশ্যত যে বিভেদ বাংলা, ইংরেজি আর আরবী মাধ্যমে শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে, সেটি কী ভবিষ্যতে কোনো সামাজিক/রাষ্ট্রীয় টানাপোড়েনের জন্ম দিতে পারে?
৯. যদি করে, তাহলে একটি সুস্থ সমাজের ভেতরেই ভিন্ন একটি গোষ্ঠীর জন্ম দিয়ে চলা এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাষ্ট্র কেন স্বীকৃতি দিয়ে চলছে?
লেখাটি শুরু করেছিলাম, আমার ব্যক্তিগত ধারনার কথা বলে। সেখানে যতটুকু সরলীকরণ রয়েছে সেই দায় আমার। তবে আমি বিশ্বাস করতে চাই, ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীরাও আমাদের একজন। আমি বিশ্বাস করতে চাই, যে ছেলেটিকে দেখে আমি আমার দেশের মাটি-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা ভিন্নগ্রহের বাসিন্দা ভেবেছি, সে আসলে এই দেশেরই খুব কাছের মানুষ! কিন্তু তেমনটা চাইলেই ভাবতে পারা যায়না। যে প্রশ্নগুলোর কথা আমি বলেছি সেই প্রশ্নগুলো আরো অনেকের মনেই জেগেছে, সন্দেহ নেই! রাষ্ট্রও এই বিষয়ে মৃত্যুর মতো নিরব! সেটিও কখনোই সুস্থতার লক্ষণ নয়। আমাদের কথা বলার প্রয়োজন, আলোচনার প্রয়োজন, অলীক ধারনা তৈরি হলে তা ভেঙে দেয়া প্রয়োজন। সমস্যা থাকলে মিটিয়ে নেয়ার প্রয়োজন। এবং সেটি প্রয়োজন এখনই।
একই সঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন, যদি সত্যিই ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষাব্যবস্থা সামঞ্জস্যহীন কিছু হয়ে থাকে তাহলে সেখানে যেসব শিশুরা পড়ছে, তাদেরকে এই সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জসস্যহীন সেই ব্যবস্থায় ফেলে দেয়ার দায় আমাদেরই! নির্বুদ্ধিতার সেই দায় আমাদেরকেই মেটাতে হবে। আমাদের জাতির মেরুদণ্ড কতটা ঋজু আর সুদৃঢ় হবে সেটা র্নিভর করে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার উপরেই! আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় তাই কোনো অন্ধকার/অসামঞ্জস্য থাকার সুযোগ নেই!
কমেন্টে বেশী দিয়েন গাইল দিয়েন না ভাই।
No comments:
Post a Comment