শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। বাংলাদেশের
সংবিধানে এই মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি আছে। ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি
গৃহীত হওয়ার প্রায় চার বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এখন শিক্ষা আইন প্রণয়নের কাজ
চলছে। আজকের আলোচনা প্রাথমিক শিক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।
বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা হয় ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯১৯ সালে, তবে তা পৌর এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৩০ সালে বেঙ্গল (রুরাল) প্রাইমারি এডুকেশন অ্যাক্ট প্রবর্তনের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে ৬-১১ বছরের ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হয়। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা এবং ১৯৫৯ সালে শিশু অধিকারের ঘোষণায় প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
ব্রিটিশ-উত্তর পাকিস্তানে ১৯৫১ সালে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদে পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালে ২১ দফায় বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে। ১৯৫৯ সালের জাতীয় শিক্ষা কমিশন পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন এবং ১৫ বছরের মধ্যে আট বছর মেয়াদি বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তনের সুপারিশ করে। প্রায় একই সময়ে ইউনেসকোর উদ্যোগে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ২০ বছর মেয়াদি ‘করাচি পরিকল্পনা’ প্রণীত হয়। তাতে বলা হয়, এই অঞ্চলের ১৫টি দেশে সাত বছর মেয়াদি সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা চালু করতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য দেশগুলোর দেশজ উৎপাদনের অন্তত ৭ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দের সুপারিশ করা হয়।
স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করে। ১৯৭৪ সালে কুদরাত-এ-খুদা প্রণীত ‘বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন’ ১৯৮৩ সালের মধ্যে প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করে। ১৯৮১ সালে পৃথক প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় ২০১৫ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় লিঙ্গবৈষম্যের অবসান ঘটানোর জন্য সব দেশ একমত হয়।
২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি ১৯১৮ সালের মধ্যে দেশে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। তাতে আরও বলা হয়, ‘প্রাথমিক শিক্ষা হবে সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক এবং সবার জন্য একই মানের।’ ২০১০-১১ সালের মধ্যে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি ১০০ শতাংশে উন্নীত করা হবে। প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলা হয়: কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি সব ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বাধ্যতামূলক করা; মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর দেশাত্মবোধের বিকাশ ও দেশ গঠনমূলক কাজে উদ্বুদ্ধ করা; শিশুর মনে ন্যায়বোধ, কর্তব্যবোধ, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, মানবাধিকার, কৌতূহল, প্রীতি, সৌহার্দ্য, অধ্যবসায় ইত্যাদি নৈতিক ও আত্মিক গুণাবলি অর্জনে সহায়তা করা; বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিমনস্ক করা এবং কুসংস্কারমুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে উৎসাহিত করা; শিক্ষার্থীকে জীবনযাপনের জন্য আবশ্যকীয় জ্ঞান, বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা, জীবন-দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, সামাজিক সচেতনতা অর্জন এবং পরবর্তী স্তরের শিক্ষা লাভের উপযোগী করে গড়ে তোলা; কায়িক শ্রমের প্রতি আগ্রহ ও মর্যাদাবোধ এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষা সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণা সৃষ্টি; আদিবাসীসহ সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার স্ব স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করা; সব ধরনের প্রতিবন্ধীসহ সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত ছেলেমেয়েদের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
বলা হয়, বহুধাবিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থার (কমিউনিটি বিদ্যালয়, রেজিস্ট্রিকৃত ও রেজিস্ট্রিহীন বিদ্যালয়, সরকারি বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন, গ্রামীণ ও শহুরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা ইত্যাদি) মধ্যে বিরাজমান প্রকট বৈষম্য দূর ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে আট বছর মেয়াদি সমন্বিত শিক্ষা কর্মসূচি চালু করা হবে। গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ বিকাশের জন্য পারস্পরিক মতাদর্শের প্রতি সহনশীল হওয়া এবং জীবনমুখী ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশে সহায়তা করা, মুখস্থবিদ্যার পরিবর্তে আনন্দদায়ক সৃজনশীল পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থী যাতে চিন্তা ও কল্পনাশক্তির বিকাশ ও অনুসন্ধিৎসু মননের অধিকারী হয়ে মানসম্মত প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, তা নিশ্চিত করা হবে।
শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে স্তরভিত্তিক কৌশলে উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা বাস্তবতা ও চাহিদার আলোকে পুনর্বিন্যাস করা এবং স্থানীয় জনসাধারণকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হবে। ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক বিকেন্দ্রীকরণ, ব্যবস্থাপনা কমিটিকে আরও ক্ষমতা প্রদান, নারী অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি, যথাযথ মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগে শিক্ষক নির্বাচন কমিশন গঠন, প্রধান শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষকদের বার্ষিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রণয়ন, কার্যকর পরিবীক্ষণের লক্ষ্যে পরিদর্শন ও মূল্যায়ন ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন সাধন করা হবে।
এ ছাড়া, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, দেশে-বিদেশে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষকের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, শিক্ষকের দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি, ২০১৮ সাল নাগাদ শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৩০-এ উন্নীত করা, ছুটির সময় ব্যতীত শিক্ষাসংক্রান্ত কাজের বাইরে অন্য কাজে শিক্ষকদের সম্পৃক্ত না করার কথা বলা হয়েছে।
শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রসঙ্গে ধারানির্বিশেষে সব শিক্ষার্থীকে নির্দিষ্ট শ্রেণির পাঠ্যসূচি অনুযায়ী বাংলা, ইংরেজি, নৈতিক শিক্ষা, বাংলাদেশ স্টাডিজ, গণিত, সামাজিক পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণাসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিচিতি এবং তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বাধ্যতামূলক করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জীবন উপযোগী প্রাক-বৃত্তিমূলক ও তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা প্রদান করা হবে, যাতে কোনো কারণে যারা উচ্চতর স্তরের শিক্ষা লাভ করতে পারবে না, তারাও কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়।
শিক্ষা মূল্যায়ন বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্কুল কর্তৃক ধারাবাহিক মূল্যায়ন, তৃতীয় শ্রেণি থেকে ত্রৈমাসিক, অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। পঞ্চম শ্রেণি শেষে অভিন্ন প্রশ্নে সমাপনী পরীক্ষা এবং অষ্টম শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষা (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা—জেএসসি) সংশ্লিষ্ট বোর্ড গ্রহণ করবে।
এখন দেখা যাক, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার স্তর উন্নয়নে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তার জন্য সরকারকে কী কী করতে হবে। বহুধাবিভক্ত প্রাথমিক শিক্ষায় সমন্বয়ের জন্য কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন? মোটা দাগে বলা যায়, বিদ্যমান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের লক্ষ্যে সম্পদের পুনর্বিন্যাস ও জনবল কাঠামোকে ঢেলে সাজাতে হবে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কীভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করা যাবে, তার নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সরকারি শিক্ষকদের সঙ্গে কীভাবে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরি সমন্বয় করা হবে, তারও বিহিত হওয়া প্রয়োজন। একইভাবে মাধ্যমিক স্তরকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করতে বিদ্যমান উচ্চমাধ্যমিক কলেজগুলোকে কীভাবে মাধ্যমিক স্তরের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে? প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক, অধ্যক্ষ, প্রভাষকদের চাকরি, বেতনক্রম, প্রশাসনিক জটিলতা দূরীকরণের মতো বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে। রয়েছে বিষয় শিক্ষক নিয়োগের জটিলতাও। অবসান ঘটাতে হবে নানা ধারার শিক্ষাব্যবস্থার।
এসব সমস্যা নিরসনে প্রথমেই নতুন কিন্ডারগার্টেন, নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় ও উচ্চমাধ্যমিক কলেজ প্রতিষ্ঠার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা জরুরি। বর্তমানে অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছয়টি শ্রেণির (প্রাক-প্রাথমিকসহ) শ্রেণিকক্ষের অপ্রতুলতা প্রকট। অবকাঠামো উন্নয়নে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে, যেখানে সমৃদ্ধ পাঠাগার ও হাতে-কলমে শিক্ষার জন্য গবেষণাগার থাকবে।
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বিশ্বব্যাপী প্রচলিত। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণি শেষে সমাপনী পরীক্ষার জগদ্দল পাথর দুনিয়ার কোথাও নেই। আবার অষ্টম শ্রেণি শেষে জেএসসি পরীক্ষাও শিক্ষানীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করতে হলে জেএসসি পরীক্ষার নাম পরিবর্তন করে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা করা উচিত এবং এ জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড গঠন করার প্রয়োজন হতে পারে।
কিন্তু এসব বিষয়ে সরকারের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই।
বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা হয় ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯১৯ সালে, তবে তা পৌর এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৩০ সালে বেঙ্গল (রুরাল) প্রাইমারি এডুকেশন অ্যাক্ট প্রবর্তনের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে ৬-১১ বছরের ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হয়। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা এবং ১৯৫৯ সালে শিশু অধিকারের ঘোষণায় প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
ব্রিটিশ-উত্তর পাকিস্তানে ১৯৫১ সালে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদে পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালে ২১ দফায় বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে। ১৯৫৯ সালের জাতীয় শিক্ষা কমিশন পরবর্তী ১০ বছরের মধ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন এবং ১৫ বছরের মধ্যে আট বছর মেয়াদি বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তনের সুপারিশ করে। প্রায় একই সময়ে ইউনেসকোর উদ্যোগে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ২০ বছর মেয়াদি ‘করাচি পরিকল্পনা’ প্রণীত হয়। তাতে বলা হয়, এই অঞ্চলের ১৫টি দেশে সাত বছর মেয়াদি সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা চালু করতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য দেশগুলোর দেশজ উৎপাদনের অন্তত ৭ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দের সুপারিশ করা হয়।
স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু সরকার প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করে। ১৯৭৪ সালে কুদরাত-এ-খুদা প্রণীত ‘বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন’ ১৯৮৩ সালের মধ্যে প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করে। ১৯৮১ সালে পৃথক প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতিসংঘ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় ২০১৫ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় লিঙ্গবৈষম্যের অবসান ঘটানোর জন্য সব দেশ একমত হয়।
২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি ১৯১৮ সালের মধ্যে দেশে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তনের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে। তাতে আরও বলা হয়, ‘প্রাথমিক শিক্ষা হবে সর্বজনীন, বাধ্যতামূলক, অবৈতনিক এবং সবার জন্য একই মানের।’ ২০১০-১১ সালের মধ্যে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তি ১০০ শতাংশে উন্নীত করা হবে। প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে বলা হয়: কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে এক ও অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি সব ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বাধ্যতামূলক করা; মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর দেশাত্মবোধের বিকাশ ও দেশ গঠনমূলক কাজে উদ্বুদ্ধ করা; শিশুর মনে ন্যায়বোধ, কর্তব্যবোধ, শৃঙ্খলা, শিষ্টাচার, অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি, মানবাধিকার, কৌতূহল, প্রীতি, সৌহার্দ্য, অধ্যবসায় ইত্যাদি নৈতিক ও আত্মিক গুণাবলি অর্জনে সহায়তা করা; বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিমনস্ক করা এবং কুসংস্কারমুক্ত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে উৎসাহিত করা; শিক্ষার্থীকে জীবনযাপনের জন্য আবশ্যকীয় জ্ঞান, বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা, জীবন-দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ, সামাজিক সচেতনতা অর্জন এবং পরবর্তী স্তরের শিক্ষা লাভের উপযোগী করে গড়ে তোলা; কায়িক শ্রমের প্রতি আগ্রহ ও মর্যাদাবোধ এবং বৃত্তিমূলক শিক্ষা সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণা সৃষ্টি; আদিবাসীসহ সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার স্ব স্ব মাতৃভাষায় শিক্ষার ব্যবস্থা করা; সব ধরনের প্রতিবন্ধীসহ সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত ছেলেমেয়েদের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
বলা হয়, বহুধাবিভক্ত শিক্ষাব্যবস্থার (কমিউনিটি বিদ্যালয়, রেজিস্ট্রিকৃত ও রেজিস্ট্রিহীন বিদ্যালয়, সরকারি বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন, গ্রামীণ ও শহুরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মাদ্রাসা ইত্যাদি) মধ্যে বিরাজমান প্রকট বৈষম্য দূর ও সমন্বয়ের লক্ষ্যে আট বছর মেয়াদি সমন্বিত শিক্ষা কর্মসূচি চালু করা হবে। গণতান্ত্রিক চেতনাবোধ বিকাশের জন্য পারস্পরিক মতাদর্শের প্রতি সহনশীল হওয়া এবং জীবনমুখী ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বিকাশে সহায়তা করা, মুখস্থবিদ্যার পরিবর্তে আনন্দদায়ক সৃজনশীল পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থী যাতে চিন্তা ও কল্পনাশক্তির বিকাশ ও অনুসন্ধিৎসু মননের অধিকারী হয়ে মানসম্মত প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করতে পারে, তা নিশ্চিত করা হবে।
শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে স্তরভিত্তিক কৌশলে উল্লেখ করা হয়েছে যে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা বাস্তবতা ও চাহিদার আলোকে পুনর্বিন্যাস করা এবং স্থানীয় জনসাধারণকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হবে। ব্যবস্থাপনার সামগ্রিক বিকেন্দ্রীকরণ, ব্যবস্থাপনা কমিটিকে আরও ক্ষমতা প্রদান, নারী অভিভাবকদের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি, যথাযথ মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগে শিক্ষক নির্বাচন কমিশন গঠন, প্রধান শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষকদের বার্ষিক মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রণয়ন, কার্যকর পরিবীক্ষণের লক্ষ্যে পরিদর্শন ও মূল্যায়ন ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন সাধন করা হবে।
এ ছাড়া, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, দেশে-বিদেশে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষকের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, শিক্ষকের দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি, ২০১৮ সাল নাগাদ শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত ১:৩০-এ উন্নীত করা, ছুটির সময় ব্যতীত শিক্ষাসংক্রান্ত কাজের বাইরে অন্য কাজে শিক্ষকদের সম্পৃক্ত না করার কথা বলা হয়েছে।
শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রসঙ্গে ধারানির্বিশেষে সব শিক্ষার্থীকে নির্দিষ্ট শ্রেণির পাঠ্যসূচি অনুযায়ী বাংলা, ইংরেজি, নৈতিক শিক্ষা, বাংলাদেশ স্টাডিজ, গণিত, সামাজিক পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণাসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ পরিচিতি এবং তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞান বাধ্যতামূলক করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জীবন উপযোগী প্রাক-বৃত্তিমূলক ও তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা প্রদান করা হবে, যাতে কোনো কারণে যারা উচ্চতর স্তরের শিক্ষা লাভ করতে পারবে না, তারাও কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়।
শিক্ষা মূল্যায়ন বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্কুল কর্তৃক ধারাবাহিক মূল্যায়ন, তৃতীয় শ্রেণি থেকে ত্রৈমাসিক, অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণ করা হবে। পঞ্চম শ্রেণি শেষে অভিন্ন প্রশ্নে সমাপনী পরীক্ষা এবং অষ্টম শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষা (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা—জেএসসি) সংশ্লিষ্ট বোর্ড গ্রহণ করবে।
এখন দেখা যাক, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার স্তর উন্নয়নে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তার জন্য সরকারকে কী কী করতে হবে। বহুধাবিভক্ত প্রাথমিক শিক্ষায় সমন্বয়ের জন্য কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন? মোটা দাগে বলা যায়, বিদ্যমান প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের লক্ষ্যে সম্পদের পুনর্বিন্যাস ও জনবল কাঠামোকে ঢেলে সাজাতে হবে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কীভাবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত করা যাবে, তার নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সরকারি শিক্ষকদের সঙ্গে কীভাবে বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরি সমন্বয় করা হবে, তারও বিহিত হওয়া প্রয়োজন। একইভাবে মাধ্যমিক স্তরকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করতে বিদ্যমান উচ্চমাধ্যমিক কলেজগুলোকে কীভাবে মাধ্যমিক স্তরের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে? প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক, অধ্যক্ষ, প্রভাষকদের চাকরি, বেতনক্রম, প্রশাসনিক জটিলতা দূরীকরণের মতো বিষয়গুলোর দিকে নজর দিতে হবে। রয়েছে বিষয় শিক্ষক নিয়োগের জটিলতাও। অবসান ঘটাতে হবে নানা ধারার শিক্ষাব্যবস্থার।
এসব সমস্যা নিরসনে প্রথমেই নতুন কিন্ডারগার্টেন, নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় ও উচ্চমাধ্যমিক কলেজ প্রতিষ্ঠার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা জরুরি। বর্তমানে অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছয়টি শ্রেণির (প্রাক-প্রাথমিকসহ) শ্রেণিকক্ষের অপ্রতুলতা প্রকট। অবকাঠামো উন্নয়নে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে হবে, যেখানে সমৃদ্ধ পাঠাগার ও হাতে-কলমে শিক্ষার জন্য গবেষণাগার থাকবে।
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা বিশ্বব্যাপী প্রচলিত। কিন্তু পঞ্চম শ্রেণি শেষে সমাপনী পরীক্ষার জগদ্দল পাথর দুনিয়ার কোথাও নেই। আবার অষ্টম শ্রেণি শেষে জেএসসি পরীক্ষাও শিক্ষানীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত উন্নীত করতে হলে জেএসসি পরীক্ষার নাম পরিবর্তন করে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা করা উচিত এবং এ জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বোর্ড গঠন করার প্রয়োজন হতে পারে।
কিন্তু এসব বিষয়ে সরকারের কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই।
No comments:
Post a Comment